রোজার ঈদের ছুটিতে দুর্গম কোথাও যেতে ইচ্ছা হলো। যেখানে মানুষের ভিড় বা কোলাহল থাকবে না। নিজের মতো করে প্রকৃতির সৌন্দর্যে ডুব দেওয়া যাবে। কিন্তু কোথায় যাব, কীভাবে যাব, থাকব কোথায়—এসব নিয়ে যখন আকাশ–পাতাল ভাবছি, তখনই হঠাৎ মনে পড়ল অনুজপ্রতিম জাহিদ রুমানের কথা।
রুমান দীর্ঘদিন থেকেই ‘তরুপল্লব’-এর সহযোদ্ধা এবং উদ্ভিদবিষয়ক লেখক। রুমান জানিয়েছিল তার পৈতৃক আবাস চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড হলেও বান্দরবানের দুর্গম নাইক্ষ্যংছড়িতে পাহাড়ের ভেতর তাদের একটি বাড়ি আছে। ওখানেই কেটেছে তার শৈশব। সাতপাঁচ না ভেবে ওর সঙ্গে যোগাযোগ করি। আমার পরিকল্পনার কথা জানাই।
উচ্ছ্বসিত রুমান একবাক্যেই সম্মতি জানায়। তারপর যাওয়ার আয়োজন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। নির্দিষ্ট দিনে সদলবল পৌঁছে যাই সদ্য নির্মিত কক্সবাজার রেলস্টেশনে। সেখান থেকে রামু হয়ে ওদের গ্রাম তুলাতলী যেতে ৪০ মিনিট সময় লাগবে। স্টেশন থেকে ওদের বাড়ি পর্যন্ত যেতে গ্রীষ্মের ভয়ংকর তাপটা অনুভব করি। রুমান আশ্বস্ত করে, রাতে রীতিমতো শীত নেমে আসবে! ওর কথাই সত্যি হলো, এপ্রিলের এমন তাপপ্রবাহের দিনেও মধ্যরাত থেকে আমাদের কাঁথা জড়িয়ে ঘুমাতে হলো!
পরদিন দ্রুত বিছানা ছাড়তে হলো। সূর্য তেতে ওঠার আগেই বাড়ির পেছনে টিলার গাছগুলো দেখতে যাওয়ার কথা। এ অভিযানে নেতৃত্ব দিচ্ছে প্রকৃতিবন্ধু সুদীপ্ত তারেক ও মেহেদী হাসান। আমরা ঢাল বেয়ে বেয়ে টিলার ওপরে উঠি। এই সংক্ষিপ্ত অভিযানে আমরা খুঁজে পেলাম চাপালিশ, কইনার, কুরচি, শিমুল, ধারমারা, বনচালতা, ভূমিজ অর্কিড, বুনো রঙ্গনসহ আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ উদ্ভিদ। রামু উপজেলা থেকে ১১ কিলোমিটার দূরত্বের এই পার্বত্য অঞ্চল একসময় জঙ্গলাকীর্ণ ছিল।
মানুষের আনাগোনা বাড়তে থাকায় ক্রমেই এখানকার দুর্লভ উদ্ভিদের সংখ্যা কমেছে। চমকপ্রদ বিষয় হলো কইনারের গাছটি একেবারে ওদের ঘরের কোনায় পাওয়া গেল। অনেকগুলো সুগন্ধি ফুল ফুটে আছে। গন্ধরাজ পরিবারের এই গাছ আমার খুবই প্রিয়। পার্বত্য চট্টগ্রামে বিক্ষিপ্তভাবে অনেক দেখেছি। ঢাকার মিরপুরে অবস্থিত জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানে কয়েকটি গাছ আছে। এ ছাড়া তেজগাঁও লাভ রোডে একটি গাছ দেখেছি। এতক্ষণ যা কিছু দেখা হলো, তা থেকে আলাদা করে বুনো রঙ্গন নিয়ে দু–একটি কথা বলতে হয়। আমাদের কাছে ফুলটি বুনো রঙ্গন হলেও পাহাড়ের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর কাছে বিজুফুল বা বিওফুল নামও পরিচিত। প্রায় দেড় দশক আগে গাছটি প্রথম দেখি গাজীপুর শালবনে। তারপর আমাদের অনেক বন-পাহাড়েও দেখেছি।
ছোট্ট টিলার এমাথা–ওমাথা দেখতে বেশি সময় লাগল না। এবার আমাদের ঘরে ফেরার পালা। টিলা থেকে ঢাল বেয়ে বিকল্প পথে আমাদের নামতে হলো। খানিকটা নিচে নেমে আবার ওপরে উঠতে হবে। একটুকরা সমতলে এসেই চোখে পড়ল ফলভর্তি একটি গাছ। এখানে এমন একটি গাছ দেখতে পাব ভাবিনি। প্রথমে হকচকিয়ে গেলেও পরে ভালোভাবে লক্ষ করি। এটা আসলে জামগাছ। তবে সচরাচর আমরা যে জাম দেখি, এ জাম ঠিক তেমনটা নয়। উদ্ভিদবিদ ড. মাকসুদা খাতুন জানালেন, এটি নালিজাম। বন-পাহাড়ের এই জাম সমতলে কোথাও দেখিনি।
নালিজামের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি তুলে ধরার মধ্য দিয়ে এই লেখা শেষ হতে পারে। নালিজাম (Syzygium claviflorum) ছোট বা মাঝারি আকারের সুদর্শন চিরহরিৎ বৃক্ষ। প্রায় ১২ মিটার উঁচু হতে পারে। বাকল মসৃণ, ধূসর বা বাদামি রঙের। পাতা ৭ থেকে ১৫ সেমি, দীর্ঘায়ত, উপবৃত্তাকার, পুরু, শীর্ষ দীর্ঘাগ্র, পার্শ্বশিরা সরু, উপসমান্তরাল, মধ্যশিরা নিম্নপৃষ্ঠে সুস্পষ্ট এবং পত্রবৃন্ত ৩ থেকে ৭ মিমি লম্বা। ফুল অবৃন্তক ও সাদা। বৃতির নল বেলুনের মতো। পাপড়ি ৪টি, মুক্ত, আড়াআড়িভাবে ৩ থেকে ৫ মিমি। পুংকেশর অসংখ্য, ১৭ মিমি পর্যন্ত লম্বা। ফল পরিপক্ব অবস্থায় নীলাভ কালো, দেখতে অনেকটা বন্দুকের গুলির মতো। ফুল ও ফলের মৌসুম মার্চ থেকে মে পর্যন্ত বিস্তৃত। নালিজাম সিলেট, পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং কক্সবাজার জেলার বনভূমিতে প্রাকৃতিকভাবে জন্মে। কাঠ যন্ত্রপাতির হাতল ও কয়লা তৈরিতে ব্যবহার্য। মালয়েশিয়ায় পাকা ফল আচার হিসেবে সংরক্ষণ করা হয়।
মোকারম হোসেন, প্রকৃতি ও পরিবেশবিষয়ক লেখক