দুর্লভ কাটুয়া ইগল

পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জের মারেয়া এলাকায় একটি উড়ন্ত কাটুয়া ইগল
ছবি: লেখক

সকালটা পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জ উপজেলার তেলিয়াপাড়া চরে পাখি পর্যবেক্ষণ করে দুপুর পৌনে ১২টায় মারেয়ার উদ্দেশে রওনা হলাম। পথে দুপুরের খাবার সেরে প্রায় দুই ঘণ্টা পর পৌঁছালাম মারেয়ায়। সিএনজিচালিত অটোরিকশা থেকে নেমেই করতোয়া নদীর পাড়ের শালবনের দিকে হাঁটা দিলাম।

মাত্র কয়েক কদম হেঁটেছি, এমন সময় দূর আকাশে একটি পাখিকে উড়তে দেখলাম। তিন-চারটা সাক্ষী ছবি তুলে শালবনের সামনে নদীর পাড়ে এসে দাঁড়ালাম। নদীর মাঝখানের একচিলতে চরে একটি মাছমুরাল অলসভাবে বসে আছে। নদীতীরের ঘাসের ওপর ভাবলেশহীনভাবে দাঁড়িয়ে আছে মাঠ–চড়াই। প্রায় শুকিয়ে যাওয়া নদীতে পোঁতা বাঁশে ছোট মাছরাঙারা বসে আছে শিকারের অপেক্ষায়।

আকাশে উড়ছে নাকুটি পাখি, মাঝেমধ্যেই ওরা নিচের দিকে ডাইভ মেরে মাছ শিকার করছে। একটা ভুবন চিল ধীরগতিতে উড়ে গেল। নদীতীরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এসব দৃশ্য দেখে ভালোই লাগছিল। এমন সময় শালবনের ওপর দিয়ে উড়ে এল একটি শিকারি পাখি।

আমার ঠিক মাথার ওপর কয়েক চক্কর মেরে হঠাৎ উধাও হয়ে গেল। মারেয়ায় ঢোকার মুখে যে পাখিকে উড়তে দেখেছিলাম, সেটাই নয়তো? ভালো ছবি তোলার আগেই পাখিটি চলে গেল। মনটাই খারাপ হয়ে গেল। কিন্তু না, মাত্র মিনিট পাঁচেক পর ও আবার ফিরে এল। এবার যায় কোথায়? একটুও সময় নষ্ট না করে যতটা সম্ভব ওর বেশ কিছু ভালো ছবি তুলে নিলাম।

চিলের মতো দেখতে শিকারি পাখিটির ডানা সরু ও লম্বা। লম্বা লেজটির শেষ প্রান্ত চৌকোনা। পাখিটির তিনটি বর্ণরূপ রয়েছে; যেমন ফ্যাকাশে, গাঢ় ও লালচে। মারেয়ায় দেখা পাখিটি ফ্যাকাশে রূপের। ভারতের রাজস্থানের ভরতপুর পক্ষী অভয়ারণ্যে ২০২০ সালে লালচে রূপের একটি পাখি দেখেছিলাম। ফ্যাকাশে রূপের পাখির মাথা, ঘাড়, ডানা-ঢাকনিসহ দেহের ওপরটা গাঢ় বাদামি।

দেহতল সাদা; তবে গাঢ় রূপের ক্ষেত্রে তা হয় গাঢ় বাদামি ও লালচে রূপের ক্ষেত্রে লালচে। বসা অবস্থায় ডানার আগা লেজের আগা পর্যন্ত পৌঁছায় না। উড়ন্ত অবস্থায় কাঁধে দুটি সাদা পট্টি, ডানার ফ্যাকাশে ডোরা, লেজ-ঢাকনিতে ‘ইউ’ আকারের সাদা দাগ ও লেজের নিচের হালকা ডোরা চোখে পড়ে। চোখের রং বাদামি। চঞ্চু গাঢ় ধূসর। ওপরের চঞ্চুর গোড়া হলুদ। পা পালকে আচ্ছাদিত থাকে। পা, আঙুল ও পায়ের পাতা অনুজ্জ্বল হলুদ। স্ত্রী-পুরুষ ও অপ্রাপ্তবয়স্ক পাখি দেখতে এই রকম। প্রাপ্তবয়স্ক পাখির দৈর্ঘ্য ৪৫-৫৫ সেন্টিমিটার ও প্রসারিত ডানা ১১০-১৩০ সেন্টিমিটার। ওজনে পুরুষ ৭১০ গ্রাম ও স্ত্রী ৯৭৫ গ্রাম।

শীতে পাখিটিকে দেশজুড়ে, বিশেষ করে রাজশাহী, রংপুর ও ঢাকা বিভাগের মুক্তাঞ্চল, কুঞ্জবন, নদীর চর, আবাদি জমি ইত্যাদিতে একাকী বা জোড়ায় দেখা যায়। বেশির ভাগ সময় আকাশে উড়ে কাটায়। গাছের ডাল থেকে বা আকাশে উড়ে ছোট স্তন্যপায়ী প্রাণী বা পাখির সন্ধান করে। শিকার দেখামাত্র প্রবল বেগে নিচে নেমে পায়ের ধারালো নখে গেঁথে ফেলে। সচরাচর ‘কি-কিই...’ শব্দে ডাকে।

মার্চ থেকে জুন প্রজনন মৌসুম। এ সময় পুরুষ পাখি ‘পি-পি-পি-পি-পিই...’ স্বরে ডেকে স্ত্রীকে আকর্ষণ করে। আবাস এলাকা অর্থাৎ মধ্য এশিয়া ও দক্ষিণ সাইবেরিয়ার গাছের ডালে বা পাহাড়ের চূড়ায় ছোট গাছে ডালপালা ও কাঠিকুটি দিয়ে বাসা গড়ে। সবুজ পাতা দিয়ে বাসার গদি বানায়। প্রতিবছর বাসা মেরামত করে। স্ত্রী সাদা রঙের দুটি ডিম পাড়ে ও তাতে একাই তা দেয়। এ সময় পুরুষ স্ত্রীকে খাওয়ায়। ডিম ফোটে ৩৭-৪০ দিনে। ছানারা ৬৫-৭০ দিনে উড়তে শেখে। তবে এরপরও প্রায় ৪০ দিন মা–বাবা ছানাদের খাওয়ায়। আয়ুষ্কাল প্রায় ১৮ বছর।

দেবীগঞ্জের মারেয়ায় দেখা শিকারি পাখিটি এ দেশের দুর্লভ পরিযায়ী পাখি কাটুয়া ইগল। কাটুয়া চিল বা কাজলা বাজ নামেও পরিচিত। পশ্চিমবঙ্গে বলে বাঘাতি বাজ। ইংরেজি নাম বুটেড ইগল। অ্যাক্সিপিট্রিডি গোত্রের পাখিটির বৈজ্ঞানিক নাম Hieraaetus pennatus। বাংলাদেশসহ দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া, দক্ষিণ সাইবেরিয়া, আফ্রিকা ও দক্ষিণ ইউরোপে পাখিটির বৈশ্বিক বিস্তৃতি রয়েছে।

আ ন ম আমিনুর রহমান, পাখি ও বন্য প্রাণী চিকিৎসা বিশেষজ্ঞ