সাত বছরেও প্রস্তাবেই রয়ে গেল বর্জ্য পরিশোধনাগার

নারায়ণগঞ্জে ডাইং ও ওয়াশিং শিল্পকারখানার নির্গত তরল বর্জ্যে মরতে বসেছে শীতলক্ষ্যা।

  • জেলায় তরল বর্জ্য নির্গমনকারী ৪৪১টি শিল্পকারখানা রয়েছে।

  • ফতুল্লায় শতাধিক কারখানা থেকে বছরে ১ কোটি ৮০ লাখ লিটার তরল বর্জ্য বের হয়।

এটি সাভারের চামড়াশিল্প নগরীর কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধনাগার (সিইটিপি)। এত বছরেও যা পুরোপুরি কার্যকর হয়নি। অনবরত দূষিত হচ্ছে ধলেশ্বরী নদী। এতে পুরো এলাকার পরিবেশ হুমকির মুখে। সম্প্রতি তোলা
ছবি: শুভ্র কান্তি দাশ

নারায়ণগঞ্জে ডাইং ও ওয়াশিং শিল্পকারখানার নির্গত তরল বর্জ্যে দূষিত হচ্ছে পরিবেশ। মরতে বসেছে শীতলক্ষ্যা নদী। এসব বর্জ্য পরিশোধনে দুটি কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধনাগার (সিইটিপি) নির্মাণের প্রস্তাব দিয়েছিল পরিবেশ অধিদপ্তর। প্রস্তাবসহ সমীক্ষা প্রতিবেদন জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে জমাও দেওয়া হয়। কিন্তু সাত বছরেও তা বাস্তবায়নে উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।

নারায়ণগঞ্জের তৎকালীন জেলা প্রশাসক ও বর্তমানে রাজউক চেয়ারম্যান আনিসুর রহমান মিয়া বলেন, শিল্পকারখানার বর্জ্যের দূষণ নিয়ে বেশ কয়েক দফা বৈঠক হয়েছিল। পরিবেশ অধিদপ্তর তখন পরিবেশ ও নদীদূষণ রোধে বেশ কিছু প্রস্তাব দিয়েছিল। পরে তিনি অন্যত্র বদলি হয়ে যান। ওই প্রস্তাব বাস্তবায়িত হলে পরিবেশ ও নদীদূষণ অনেকাংশে কমে যেত।

সম্প্রতি নগরের আলী আহাম্মদ চুনকা পাঠাগারে ‘পরিবেশদূষণে বিপর্যস্ত নারায়ণগঞ্জ: উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক গণশুনানিতে শীতলক্ষ্যা দূষণ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন বক্তারা। দূষণ রোধে কার্যকর উদ্যোগ নিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান বক্তারা।

দূষণের কবলে শীতলক্ষ্যাসহ চার নদী মরে যাচ্ছে। তাই আমাদের নদী বাঁচাতে হবে, শিল্পমালিকদেরও বাঁচাতে হবে। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় দূষণ রোধে দ্রুত কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে
জেলা প্রশাসক মঞ্জুরুল হাফিজ

পরিবেশ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, নারায়ণগঞ্জে তরল বর্জ্য নির্গমনকারী শিল্পপ্রতিষ্ঠান রয়েছে ৪৪১টি। এর মধ্যে নিজস্ব বর্জ্য পরিশোধনাগার (ইটিপি) রয়েছে ৩২২টি শিল্পকারখানার। ইটিপি নেই ১১৯টি শিল্পপ্রতিষ্ঠানের। দূষণের অভিযোগে গত ৬ মাসে ১৮টি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে পরিবেশ আদালতে মামলা করা হয়েছে। সাতটি প্রতিষ্ঠানের গ্যাস ও বিদ্যুৎ–সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। তবে ইটিপি থাকলেও অনেক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে শতভাগ ইটিপি পরিচালনা না করার অভিযোগ রয়েছে।

২০১৫ সালের নভেম্বরে নারায়ণগঞ্জের পরিবেশ অধিদপ্তর অফিসের এক সমীক্ষা প্রতিবেদনে শিল্পপ্রতিষ্ঠানের নির্গত তরল বর্জ্যে দূষণের বিষয়টি উঠে আসে। ওই সমীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়, সদর উপজেলার ফতুল্লায় শতাধিক ডাইং ও ওয়াশিং কারখানা থেকে প্রতিদিন ৫০ হাজার লিটার তরল বর্জ্য নির্গত হয়। সে হিসাবে কারখানাগুলো বছরে ১ কোটি ৮০ লাখ লিটার তরল বর্জ্য নির্গমন করে। জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে দেওয়া ওই প্রতিবেদনে দুটি প্রধান খাল চিহ্নিত করে সিইটিপি নির্মাণের প্রস্তাব করা হয়।

পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) জেলা সভাপতি এ বি সিদ্দিক বলেন, ‘আমরা অনেক দিন ধরে কেন্দ্রীয় শোধনাগার স্থাপনের দাবি জানিয়ে আসছি।’

জেলা প্রশাসক মঞ্জুরুল হাফিজ বলেন, ‘দূষণের কবলে শীতলক্ষ্যাসহ চার নদী মরে যাচ্ছে। তাই আমাদের নদী বাঁচাতে হবে, শিল্পমালিকদেরও বাঁচাতে হবে। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় দূষণ রোধে দ্রুত কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে।’

সিইটিপি নির্মাণের প্রস্তাবে বলা হয়, হাজীগঞ্জ-দাপা ইদ্রাকপুর খালে ৬৭টি, সস্তাপুর খালে ১৯টি এবং স্টেডিয়াম-পিঠালী খালে ১০টি শিল্পকারখানা তরল বর্জ্য নির্গত করে। হাজীগঞ্জ-দাপা ইদ্রাকপুর খাল ও শীতলক্ষ্যা নদীর সংযোগস্থলে সিইটিপি নির্মাণ করা হলে ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ নদীদূষণ কমে যাবে। কারণ, এসব খালসংলগ্ন মোট ৯৬টি ডাইং ও ওয়াশিং শিল্পকারখানা রয়েছে। সে ক্ষেত্রে খাল তিনটি পুনঃখনন, পুনঃসংযোগ ও সংস্কার করতে হবে।

প্রস্তাবে বলা হয়, ফতুল্লায় অনেক শিল্পকারখানা রয়েছে, যারা বর্জ্য নির্গমন করে পরিবেশ দূষণ করছে। আবার অনেক প্রতিষ্ঠানের ইটিপি করার পর্যাপ্ত জায়গা ও আর্থিক সামর্থ্য নেই। কেন্দ্রীয় শোধনাগার করা হলে দূষণ ও পরিচালনা ব্যয় কমে আসবে।

প্রস্তাবে বলা হয়, সস্তাপুর খাল ফকির রোড ও হাজীগঞ্জ শিবু মার্কেট রোডের সংযোগস্থলে হাজীগঞ্জ–দাপা ইদ্রাকপুর খালের সঙ্গে সংযুক্ত হয়েছে। ওই মিলিত প্রবাহ পিঠালীপুল খাল হয়ে ফতুল্লা স্টেডিয়ামের বিপরীতে জলাশয়ে মিলিত হয়েছে। অন্যদিকে স্টেডিয়াম-পিঠালীপুল খাল স্টেডিয়ামের পাশ দিয়ে লিংক রোডের নিচ দিয়ে স্টেডিয়ামের বিপরীত দিকের জলাশয়ে নদীতে মিলিত হয়েছে। উভয় প্রবাহ জালকুড়ি খাল হয়ে শিল্পকারখানার তরল বর্জ্য কাঁচপুর সেতুসংলগ্ন খাল দিয়ে শীতলক্ষ্যা নদীতে যাচ্ছে। ৯০ শতাংশ তরল বর্জ্য কাঁচপুর সেতুসংলগ্ন খাল দিয়ে শীতলক্ষ্যা নদীতে পড়ছে। ফলে কাঁচপুর সেতু-সংলগ্ন সরকারি জায়গায় একটি কেন্দ্রীয় তরল বর্জ্য পরিশোধনাগার নির্মাণ করা যেতে পারে।

প্রস্তাবে অন্যান্য অপ্রধান খাল বা ড্রেন দিয়ে অল্প পরিমাণে নির্গত তরল বর্জ্য শোধনে বলা হয়, বিদ্যমান ড্রেন বা খাল দিয়ে তরল বর্জ্য নির্গমন বন্ধ করে দেওয়া যেতে পারে। তরল বর্জ্য পরিবহন বা পৃথক ড্রেনেজ সিস্টেমের মাধ্যমে সিইটিপিতে নেওয়া যেতে পারে।

প্রস্তাবে বলা হয়, ফতুল্লায় অনেক শিল্পকারখানা রয়েছে, যারা বর্জ্য নির্গমন করে পরিবেশ দূষণ করছে। আবার অনেক প্রতিষ্ঠানের ইটিপি করার পর্যাপ্ত জায়গা ও আর্থিক সামর্থ্য নেই। কেন্দ্রীয় শোধনাগার করা হলে দূষণ ও পরিচালনা ব্যয় কমে আসবে।

পরিবেশ অধিদপ্তর নারায়ণগঞ্জ কার্যালয়ের উপপরিচালক আবদুল্লাহ মামুন বলেন, কেন্দ্রীয় শোধনাগার নির্মাণের কোনো অগ্রগতি নেই। বিশ্বব্যাংক ও এডিবি সম্ভাব্যতা যাচাই করলেও সেটি বাস্তবায়নের কোনো উদ্যোগ নেই। সিইটিপি করা হলে ছোট শিল্পকারখানার জন্য ব্যয় নির্বাহ করা সহজ হতো, পরিবেশদূষণও কমে আসত।

নিট পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, পরিবেশ রক্ষায় কেন্দ্রীয় শোধনাগার স্থাপন খুবই জরুরি। ক্লাস্টারভিত্তিক শীতলক্ষ্যা, বুড়িগঙ্গা ও ধলেশ্বরী নদীর সংযোগস্থলে কেন্দ্রীয় শোধনাগার করা হলে নদীদূষণ ও পরিচালনা ব্যয় কম আসবে। দ্রুত এ উদ্যোগ বাস্তবায়ন করা উচিত।