মায়াবতী বিদেশিনী জারবেরা

ঝিনাইদহের গান্না গ্রামে ফোটা গোলাপি জারবেরা ফুল
ছবি: লেখক

শারদ গোধূলির ম্লান আলো এসে পড়েছে জারবেরার মুখে। আশ্বিনেও দিনভর বর্ষার ভেজা হাওয়া আর পলিশেডের গুমোট গরমে যে ছিল ক্লান্ত, স্থবির—সে যেন সেই দিনের শেষ আলোটুকু পেয়ে কারও প্রতীক্ষায় ঢুলু ঢুলু চোখগুলোকে জোর করে খুলে তাকিয়ে ছিল। অবশেষে আমরা তার কাছে পৌঁছালাম। লজ্জায় ওর গোলাপি অধর আরও গোলাপি হয়ে উঠল। আহা কি মিষ্টি ওর কোমল চেহারা, রং, রূপ।

যেন সে সুদূর কোনো দেশের রূপকুমারী। এত সুন্দর! জারবেরা ফুলগুলোর দিকে অপলক তাকিয়ে থাকতে থাকতে ওকে ডোনা হিলবার্টের ট্রাভেলার ইন প্যারাডাইস কাব্যের ‘ফুল’ কবিতাটি আবৃত্তি করে শোনাতে মন চাইল: Red gerbera daisies/ bending at the neck, yellow and purple/ tulips open and blowsy as roses. জারবেরাও যেন সেটিই চাইছিল।

আনন্দে তার মুখ থেকে লাজুক পর্দা সরে গেল। লম্বা বোঁটার ওপরে থাকা ঝাঁকে ঝাঁকে নানা রঙের জারবেরা ফুলগুলো যেন মৃদু হাওয়ায় নাচতে শুরু করল। ঝিনাইদহের গান্না গ্রামে ফুলচাষি মো. সোলায়মান হোসেনের জারবেরা ফুলের খেতে দাঁড়িয়ে মনে হলো আমিও যেন কবি ডোনার মতো কোনো স্বর্গের বাগানে দাঁড়িয়ে আছি।

জারবেরা বিদেশি ফুল, দেশে কবে কে নিয়ে এসেছেন জানি না। ফুলচাষিদের সঙ্গে আলাপচারিতায় জানা গেল, যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলার গদখালীতে বছর ১৫ আগে এ ফুলের চাষ শুরু হয়েছিল। কাটা তাজা ফুল হিসেবে বিদেশে এর চাষ হয়, এখন দেশেও অনেক জারবেরা ফুল উৎপাদন হচ্ছে।

বিশ্বে জারবেরা এখন তাজা কাটা ফুল হিসেবে বাণিজ্যিক দৃষ্টিতে গোলাপ, কারনেশন, চন্দ্রমল্লিকা ও টিউলিপের পর পঞ্চম অবস্থানে রয়েছে। ফুলদানি ও ফুলের তোড়া সাজাতে জারবেরা ফুলের কোনো তুলনা নেই। ফুলদানিতে কাটা জারবেরা ফুল সাত-আট দিন তাজা থাকে বলে কাটা ফুল হিসেবে এর কদর রয়েছে। তা ছাড়া রূপে ওকে হারাতে পারে কেবল চন্দ্রমল্লিকা। কিন্তু জারবেরা আবার হারিয়ে দিয়েছে চন্দ্রমল্লিকাকে ওর লম্বা বোঁটা আর হাজার জাতের হাজার রং দিয়ে।

আমাকে সঙ্গ দিচ্ছিলেন যশোরের রুরাল রিকনস্ট্রাকশন ফাউন্ডেশনের এসইপি প্রকল্পের প্রকল্প ব্যবস্থাপক অসিত বরণ মণ্ডল। তিনি জানালেন, এ সবই হাইব্রিড জাত। তাঁরা তাঁদের টিস্যু কালচার ল্যাবে মাসে প্রায় দুই হাজার জারবেরা চারা তৈরি করে ফুলচাষিদের কাছে বিক্রি করেন। সেসব চারা চাষিরা লাগান, কিছু চারা তাঁরা ভারত থেকেও সংগ্রহ করেন।

সোলায়মান এবারই প্রথম ফুল চাষ করেছেন। এর আগে ওই জমিতে কলা ও পাট হতো। বললেন, ডিসেম্বর থেকে জানুয়ারি মাসের মধ্যে চারা লাগিয়েছেন। ফুল ফোটা শুরু হয়েছে এপ্রিল থেকে। জারবেরার মজাটা হলো সারা বছরই এর ফুল ফোটে। তবে অক্টোবর থেকে মার্চে বেশি ফুল ফোটে।

বছরে একটি গাছ থেকে প্রায় ২০০টি ফুল পাওয়া যায়। প্রতিটি ফুল ৫ থেকে ২০ টাকায় বিক্রি হয়। এভাবে একটানা তিন বছর পর্যন্ত ফুল পাওয়া যায়। এরপর নতুন করে আবার চারা লাগাতে হয়। বছরে এই তিন হাজার গাছ থেকে ৮ থেকে ১০ লাখ টাকার ফুল বিক্রি হয়। যত্নœ করলে এ ফুলের চাষ অনেক লাভজনক বলে তিনি উল্লেখ করেন।

  • মৃত্যুঞ্জয় রায়, কৃষিবিদ প্রকৃতিবিষয়ক লেখক