পারিজাত নয়, পাখিফুল 

পাখিফুল। রমনা পার্ক নার্সারি থেকে
ছবি: লেখক

ইদানীং বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পাখিফুলকে ভুলভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে। পাখিফুলের পরিচয় বলা হচ্ছে পারিজাত। শুধরে দেওয়ার পরও কেউ কেউ বিষয়টি মানতে নারাজ। তাঁরা মনে করেন, এটি পাখিফুল নয়, পারিজাত। অর্থাৎ জেনেশুনে ভুলের স্বর্গে বসবাস!

আসলে পারিজাত হচ্ছে মাদার, মন্দার বা মান্দার। যার সঙ্গে পাখিফুলের কোনো সম্পর্ক নেই। মান্দার বা পাইন্যা মান্দার আমাদের নিজস্ব বৃক্ষ। দেশের নির্দিষ্ট কিছু অঞ্চলে প্রাকৃতিকভাবে জন্মে। এ অঞ্চলের নিজস্ব উদ্ভিদ প্রজাতি হিসেবে এই বৃক্ষের সঙ্গেই আমাদের ভাব-ভাবনা ও ইতিহাস-ঐতিহ্যের সংযোগ রয়েছে। অপর দিকে পাখিফুলের সঙ্গে আমাদের এমন আত্মিক কোনো সম্পর্ক নেই।

পারিজাত বা মান্দার। লক্ষ্মীপুরের রামগতি থেকে
ছবি: লেখক

কারণ, গাছটি এই অঞ্চলে এসেছে এক শ বছরের কিছু বেশি সময় আগে। অধ্যাপক দ্বিজেন শর্মার ফুলগুলি যেন কথা, নিসর্গী বিপ্রদাশ বড়ুয়ার গাছপালা তরুলতানগরে নিসর্গ গ্রন্থে এই ফুলটিকে পাখিফুল নামে উল্লেখ করা হয়েছে। মান্দারগাছই যে পারিজাত, তার কতগুলো ঐতিহাসিক সূত্রও আমাদের জানা আছে। কাজী নজরুল ইসলাম পারিজাত বৃক্ষ নিয়ে গান বেঁধেছেন

‘পরো কুন্তলে, ধরো অঞ্চলে/ অমলিন প্রেম-পারিজাত।’

প্রসঙ্গত, তাঁর লিখিত চিঠিপত্র থেকেও উদ্ধৃত করা যায়। নজরুল ও নার্গিসের বিবাহবিচ্ছেদের ১৫ বছর পর নার্গিস নজরুলকে একটি চিঠি দেন। এর উত্তরে নজরুল তাঁকে একটি চিঠি লেখেন। সেখানেও পারিজাতের প্রসঙ্গ আছে,

‘তোমার যে কল্যাণ-রূপ আমি আমার কিশোর বয়সে প্রথমে দেখেছিলাম, সে রূপ আজো স্বর্গের পারিজাত-মন্দারের মতো চির অম্লান হয়েই আছে আমার বক্ষে।’

বিপ্রদাশ বড়ুয়া গাছপালা তরুলতা গ্রন্থে পারিজাত প্রসঙ্গে লিখেছেন, ‘একদিন শ্রীকৃষ্ণ পত্নী রুক্মিণীর সঙ্গে বসেছিলেন নিজের আলয়ে। এমন সময় সেখানে দেবর্ষি নারদ এসে উপস্থিত। নারদ যথারীতি প্রণাম জানিয়ে শ্রীকৃষ্ণকে একটি পারিজাত ফুল দিলেন। দেবর্ষি নারদ স্বর্গ থেকে পারিজাত নিয়ে এসেছিলেন। শ্রীকৃষ্ণ এই ফুল তখুনি রুক্মিণীকে দিলেন।’ অন্যত্র আছে, ‘পারিজাত নামটি শিক্ষিত অনেকের জানা থাকলেও এর নাম যে মাদার তা তারা জানে না।’

রবীন্দ্রনাথ পারিজাত নিয়ে চমৎকার গান বেঁধেছেন—

‘পারিজাত কেশর নিয়ে ধরায়, শশী, ছড়াও কী এ।/ ইন্দ্রপুরীর কোন রমণী বাসরপ্রদীপ জ্বালো॥’

অবয়ব, আঙ্গিক বৈশিষ্ট্য এবং বৈজ্ঞানিক শ্রেণীকরণের দিক থেকেও যে পারিজাত বা মান্দার এবং পাখিফুল একেবারেই আলাদা, সে বিষয়েও আমাদের স্পষ্ট ধারণা থাকা প্রয়োজন। মান্দার (Erythrina fusca) মূলত ফেভেসি পরিবারের মাঝারি উচ্চতার গাছ। প্রজাতিভেদে এদের কাণ্ড, ডালপালা ভিন্ন ভিন্ন ধরনের হতে পারে। শীতকালে সব পাতা ঝরে পড়ে। বসন্তের শুরুতেই পাতাহীন ডালে থোকা থোকা উজ্জ্বল লাল রঙের ফুল ফোটে। ফুলের এমন নয়নাভিরাম শোভা থেকে সত্যিই চোখ ফেরানো যায় না। ফুল ঝরে যাওয়ার পর শিমের মতো লম্বা লম্বা ফলগুলো ঝুলতে থাকে। পানিতেও এরা দিব্যি বেঁচে থাকতে পারে।

মান্দার বা পারিজাতের তুলনায় পাখিফুল (Brownea coccinea) আমাদের দেশে বেশ দুর্লভ। ঢাকার সবচেয়ে পুরোনো গাছটি আছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যানটিনের পাশে। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বোটানিক্যাল গার্ডেন, মহেশখালীর আদিনাথ মন্দির ও নাটোরের উত্তরা গণভবনের প্রবেশপথের ধারে দুটি পরিণত গাছ আছে। বর্তমানে রমনা পার্ক, শিশু একাডেমিসহ বিভিন্ন পার্ক ও উদ্যানে নতুন গাছ দেখা যায়। চট্টগ্রামের বৌদ্ধবিহারগুলোতেও এই গাছ চোখে পড়ে। জন্মস্থান ভেনেজুয়েলায় এরা গোলাপ নামে পরিচিত।

সেই অর্থে ফুলটিকে ভেনেজুয়েলার গোলাপও বলা যেতে পারে। পৃথিবীজুড়ে এদের কয়েকটি রকমফের চোখে পড়ে। একটির সঙ্গে অন্যটির পার্থক্য অতি সূক্ষ্ম। চিরসবুজ এই গাছ পাঁচ থেকে সাত মিটার পর্যন্ত উঁচু হতে পারে। কাণ্ড ও ডালপালার দিক থেকে অশোকের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ। কচি পাতা পাখির লেজের মতো ঝুলে থাকে বলেই সম্ভবত আমাদের দেশে এমন নামকরণ।

গুচ্ছবদ্ধ ফুলগুলো ফোটে বসন্তে। শরৎকালসহ বছরের অন্যান্য সময়ে দু–চারটি ফুল ফোটা বিচিত্র নয়। একসঙ্গে ৩০–৪০টি ফুলের ঠাসবুনটে ভারি সুন্দর দেখায়। সব ফুল নিয়ে ফুলের যে থোকা, তাকেও একটি পরিপূর্ণ ফুল মনে হয়। ফুলের রং উজ্জ্বল লাল। পথতরু হিসেবে আদর্শ।

  • মোকারম হোসেন, প্রকৃতিপরিবেশবিষয়ক লেখক