মাঝারি ভূমিকম্পের বিপদ বাড়ছে

সারা দেশে গতকাল সকালে অনুভূত হওয়া ভূমিকম্পটির মাত্রা ছিল ৫.৬। দেশের ভেতরে ২৫ বছরের মধ্যে এই ভূমিকম্প ছিল সবচেয়ে শক্তিশালী।

ভূমিকম্পে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজী মুহম্মদ মুহসীন হলের পাঠকক্ষের দরজার কাচ ভেঙে যায়। গতকাল সকালে
ছবি: প্রথম আলো

বাংলাদেশে হঠাৎ মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্প বেড়ে গেছে। গতকাল শনিবার সকালে সারা দেশে অনুভূত হওয়া ভূমিকম্পটির মাত্রা ছিল রিখটার স্কেলে ৫ দশমিক ৬। এতে রাজধানীসহ দেশের বেশির ভাগ এলাকায় কম্পন ও দুলুনির পাশাপাশি রীতিমতো ঝাঁকুনি অনুভূত হয়। ভূমিকম্পবিশেষজ্ঞদের হিসাবে, গত ২৫ বছরে দেশের ভেতরে সৃষ্টি হওয়া ভূমিকম্পগুলোর মধ্যে এটি ছিল সবচেয়ে শক্তিশালী। ১৯৯৮ সালের মে মাসে সিলেটের বড়লেখায় ৫ দশমিক ৮ মাত্রার একটি ভূকম্পন সৃষ্টি হয়।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, এ বছর এ নিয়ে দেশে ৫ মাত্রার ওপরে মোট ছয়টি ভূমিকম্প হলো। এর আগে ২০২২ সালে মাঝারি মাত্রার বা রিখটার স্কেলে ৫–এর ওপরে মোট তিনটি ভূমিকম্প হয়। অথচ ১৯৭২ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে যে কটি ভূমিকম্প সৃষ্টি হয়েছে, তার মধ্যে মাঝারি মাত্রার কম্পনের ঘটনা ঘটেছে প্রতি দুই থেকে চার বছরে একবার। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মাঝারি মাত্রার কম্পন হঠাৎ বেড়ে গেছে।

আমাদের কাছে যে তথ্য আছে, তাতে লক্ষ্মীপুরে সৃষ্টি হওয়া শনিবারের ভূমিকম্পটিই সবচেয়ে শক্তিশালী। চলতি বছর দেশের বিভিন্ন স্থানে যে ভূমিকম্পগুলো সৃষ্টি হয়েছে, তার বেশির ভাগই নতুন এলাকায়। অর্থাৎ এসব এলাকা খুব কম ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ছিল।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের ভূমিকম্প বিভাগের প্রধান রুবাইয়াৎ কবীর

আতঙ্কে দোতলা থেকে লাফ

বিশ্বের শক্তিশালী ভূমিকম্পগুলোর সঙ্গে তুলনা করলে গতকালের ৫ দশমিক ৬ মাত্রা খুব বেশি তীব্র নয়। আর ভূমিকম্পের উৎসস্থলটি নদী পরিবেষ্টিত এবং মূলত পলিমাটি দিয়ে তৈরি গ্রামীণ এলাকা। ফলে ভূমিকম্পের কারণে উৎসস্থল এলাকায় তেমন ক্ষয়ক্ষতির খবর পাওয়া যায়নি। তবে রাজধানী ঢাকা, কুমিল্লাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ভবনে ফাটল এবং আতঙ্ক সৃষ্টির কারণে ক্ষয়ক্ষতির খবর পাওয়া গেছে।

ভূমিকম্পে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন আবাসিক হলে আতঙ্কে ছোটাছুটি শুরু করেন শিক্ষার্থীরা। হাজী মুহম্মদ মুহসীন হলের একটি ভবনের বিভিন্ন স্থানের পলেস্তারা খসে পড়েছে। ভেঙে গেছে হলের পাঠকক্ষের দরজার কাচ। ভূমিকম্পের সময় আতঙ্কে মাস্টারদা সূর্য সেন হলের দোতলা থেকে লাফ দেন মিনহাজুর রহমান। ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের ছাত্র মিনহাজুর ওই হলের ২৩৩ নম্বর কক্ষের জানালা দিয়ে লাফিয়ে পড়েন। পরে তাঁকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়।

আরও পড়ুন

কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে ভূমিকম্পের সময় আতঙ্কে তাড়াহুড়া করে কারখানা থেকে বের হওয়ার সময় পদপিষ্ট হয়ে শতাধিক শ্রমিক আহত হয়েছেন। গতকাল সকালে উপজেলার ছুপুয়া এলাকায় আমির শার্ট নামের একটি পোশাক কারখানায় এ ঘটনা ঘটে। আহত ব্যক্তিদের মধ্যে তিনজনকে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।

বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও ভূমিকম্পবিশেষজ্ঞ সৈয়দ হুমায়ুন আখতার মনে করেন, লক্ষ্মীপুরের ভূমিকম্পটি যে অঞ্চলে সৃষ্টি হয়েছে, সেখানে ভূ–অভ্যন্তরে বিপুল পরিমাণ শক্তি সঞ্চিত হয়ে আছে। সিলেট থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত এ এলাকায় যেকোনো জায়গায় যেকোনো সময় ভূমিকম্প হতে পারে। গতকাল হলো রামগঞ্জে, পাঁচ মাস আগে হলো নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে। এসব ঘটনা বড় ভূমিকম্প হওয়ার পূর্বলক্ষণ।

এর আগে গত বছর (২০২২) মোট তিনটি ৫ মাত্রার বেশি ক্ষমতার ভূমিকম্প হয়। ওই বছরের ১৫ আগস্ট ৫ দশমিক ১ মাত্রার এবং ২৩ জানুয়ারি ৫ দশমিক ২ মাত্রার ভূমিকম্প হয়। ওই বছর বাংলাদেশে ১৭টি ভূমিকম্প হয়। বেশির ভাগের মাত্রা ছিল ৪ থেকে ৫–এর মধ্যে। ১০টির উৎস ছিল চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার এলাকায়।

ভূমিকম্পের নতুন উৎসস্থলগুলো চিহ্নিত করার তাগিদ

বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর এবং যুক্তরাষ্ট্রের ভূতাত্ত্বিক জরিপ অধিদপ্তরের (ইউএসজিএস) হিসাবে, গত অক্টোবরে ৫ দশমিক ৪ মাত্রার আরেকটি ভূমিকম্প আঘাত হেনেছিল, যার উৎপত্তিস্থল ছিল শেরপুরে। এর আগে ১১ সেপ্টেম্বর ৫ মাত্রার, ১৪ আগস্ট ৫ দশমিক ৩ মাত্রার, ১৬ জুন ৫ মাত্রার এবং ২৩ জুন ৫ দশমিক ১ মাত্রার ভূমিকম্প আঘাত হানে। এ চার ভূমিকম্পের উৎসস্থল ছিল সিলেটে।

আরও পড়ুন

এর আগে গত বছর (২০২২) মোট তিনটি ৫ মাত্রার বেশি ক্ষমতার ভূমিকম্প হয়। ওই বছরের ১৫ আগস্ট ৫ দশমিক ১ মাত্রার এবং ২৩ জানুয়ারি ৫ দশমিক ২ মাত্রার ভূমিকম্প হয়। ওই বছর বাংলাদেশে ১৭টি ভূমিকম্প হয়। বেশির ভাগের মাত্রা ছিল ৪ থেকে ৫–এর মধ্যে। ১০টির উৎস ছিল চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার এলাকায়।

লক্ষ্মীপুরসহ চলতি বছরের সাম্প্রতিক ভূমিকম্পগুলো আমাদের গভীর ভূত্বকের মধ্যে সৃষ্টি হচ্ছে। এ ধরনের গভীর ভূত্বক এলাকাগুলোতে শক্তিশালী না হলেও মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্প আমাদের জন্য বড় বিপদ ডেকে আনতে পারে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও ভূমিকম্পবিশেষজ্ঞ মাকসুদ কামাল

দেশের ভূমিকম্পবিশেষজ্ঞরা বলছেন, জাপান, নেপাল ও আফগানিস্তানের মতো বাংলাদেশে শক্তিশালী ভূমিকম্পের খুব বেশি আশঙ্কা নেই। দেশের ভেতরে ৬ থেকে ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হওয়ার ঘটনাও খুব কম। দেশের বিশেষজ্ঞরা এ কথা অনেক দিন ধরে বলে আসছেন। অবশ্য রাজধানীসহ দেশের বড় শহরগুলোর জন্য মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্প বিপদ ডেকে আনতে পারে বলেও তাঁরা মনে করছেন।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন শিক্ষক মো. আবদুল্লাহ আল জামান ও নুসরাত আল জামানের করা এক গবেষণায় ১৯৭৬ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের ভেতরে সৃষ্টি হওয়া ভূমিকম্পগুলোর ধরন পর্যালোচনা করা হয়েছে। তাতে তাঁরা দেখতে পেয়েছেন, বাংলাদেশের ভেতরে সৃষ্টি হওয়া ভূমিকম্পগুলো মূলত ৪ থেকে ৫ মাত্রার। ওই ৪০ বছরে বাংলাদেশে মোট ২৮৪টি ভূমিকম্প সৃষ্টি হয়, যার ৭৭ শতাংশ ৪ থেকে ৫ মাত্রার। আর মাত্র ১২ শতাংশ ভূমিকম্প ৫ থেকে ৬ মাত্রার মধ্যে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও ভূমিকম্পবিশেষজ্ঞ মাকসুদ কামাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘লক্ষ্মীপুরের ভূমিকম্পটি আমাদের এখানে মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্পের বিপদ বেড়ে যাওয়ার ইঙ্গিত দিচ্ছে। এর আগে আমাদের এখানে সাধারণত ভূ–অভ্যন্তরের ফাটলরেখা বরাবর ভূমিকম্পের সৃষ্টি হওয়ার কথা জেনেছি।

কিন্তু লক্ষ্মীপুরসহ চলতি বছরের সাম্প্রতিক ভূমিকম্পগুলো আমাদের গভীর ভূত্বকের মধ্যে সৃষ্টি হচ্ছে। এ ধরনের গভীর ভূত্বক এলাকাগুলোতে শক্তিশালী না হলেও মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্প আমাদের জন্য বড় বিপদ ডেকে আনতে পারে। ফলে সারা দেশে এ ধরনের মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্পের নতুন উৎসস্থলগুলো চিহ্নিত করতে হবে। উৎসস্থল চিহ্নিত করতে পারলে সংশ্লিষ্ট এলাকার ভবনগুলোকে ভূমিকম্প সহনশীল করে তৈরি করা, স্বেচ্ছাসেবক এবং উদ্ধার যন্ত্রপাতি প্রস্তুত রাখা যাবে।’