ঢাকার বাংলা একাডেমির সবুজ গালিচায় যেন মধ্যমণি হয়ে আছে বৃক্ষটি। সুপ্রাচীন বর্ধমান হাউসের কোলে তার নিরিবিলি একান্ত অবস্থান। হেমন্তের ভোরে গাছতলায় মুক্তার মতো ফুলগুলো খেলা করে। বলার অপেক্ষা রাখে না, বৃক্ষটির নাম শিউলি। যখন পৌঁছালাম, রোদের তেজ কিছুটা চড়েছে বটে, তবে মিষ্টি ঘ্রাণ আর শুভ্রতা তখনো হারিয়ে যায়নি। সঙ্গী নিসর্গী মোকারম হোসেন বলছিলেন, শিউলি ফুলের বোঁটার উজ্জ্বল হলুদ রং একসময় মিষ্টান্ন তৈরিতে ব্যবহার্য ছিল। দ্বিজেন শর্মার শ্যামলী নিসর্গ বইয়েও তথ্যটি পেয়েছি।
বাংলার প্রকৃতিতে শরৎ ও হেমন্তের ফুল শিউলি। এর ফুলকলিরা মুখ তোলে সন্ধ্যায়। হেমন্তরাত্রি তাই শিউলির ঘ্রাণে ভরপুর। স্বল্পায়ু এই ফুল ঝরে পড়ে নিশিভোরেই। কাজী নজরুল ইসলাম শিউলিকে তুলনা করেছেন ‘বিধবার হাসি’র সঙ্গে। ক্ষণস্থায়ী আয়ুর বিষাদের জন্যই হয়তো এমন নামকরণ।
শিউলি বা শেফালির কথা এসেছে রবীন্দ্রকাব্যেও, ‘কেন সুদূর গগনে গগনে,/ আছ মিলায়ে পবনে পবনে,/ কেন কিরণে কিরণে ঝলিয়া,/ যাও শিশিরে শিশিরে গলিয়া,/ ওগো শেফালিবনের মনের কামনা।’ অপরদিকে বিভূতিভূষণের আরণ্যক উপন্যাসে আছে লবটুলিয়ার এক জঙ্গলের কথা। সে জঙ্গলে শিউলির বিশাল অরণ্য আর তীব্র সৌরভ-প্লাবিত এক সন্ধ্যায় সম্মোহিত হয়েছিলেন উপন্যাসের নায়ক।
স্নিগ্ধবর্ণ শিউলির এমনই সৌন্দর্য। নিসর্গী দ্বিজেন শর্মা একটুও ভুল লেখেননি, শিউলি ছাড়া কোনো বাগানই পরিপূর্ণ নয়। অথচ রাজধানী ঢাকায় এই গাছ একপ্রকার দুষ্প্রাপ্য। পথের পাশে বা উন্মুক্ত স্থানে চোখে পড়ে না বললেই চলে। তরুটি আরও যত্ন ও সমাদর দাবি করে।
হেমন্তের ফুলের কথা লিখতে গেলে এর পরেই আসে ছাতিমের কথা। কদম যদি বর্ষার দূত হয়, ছাতিম তবে হেমন্তের। ছাতিমই একমাত্র বৃক্ষ, যেটি হেমন্তের উঠানে দাঁড়িয়ে প্রস্ফুটন আর সুগন্ধের প্লাবনে আসন্ন-দূরবর্তী শীতকে অভ্যর্থনা জানায়। হেমন্তরাতের শীতল বাতাসে হালকা সবুজাভ সাদা রঙের ছাতিম ফুলের ঘ্রাণে সৌন্দর্যপিপাসু মানুষের হৃদয় ও মন তৃপ্ত হয়ে ওঠে। পথের পাঁচালীতে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন, ‘তাহার পর সকলে গিয়া ঘুমাইয়া পড়ে। রাত্রি গভীর হয়, ছাতিম ফুলের উগ্র সুবাসে হেমন্তের আঁচলাগা শিশিরাদ্র৴ নৈশবায়ু ভরিয়া যায়।’
ছাতিমগাছের কাঠ নরম, তাই দারুমূল্য কম। এ গাছ দ্রুত বেড়ে ওঠে। ডাল-পাতা এমনভাবে সেজে ওঠে যেন তপ্ত দুপুরে পথিকের জন্য ছাতি মেলে দাঁড়িয়ে আছে কোনো স্বজন। ঢাকায় দুষ্প্রাপ্য হলেও সারা দেশে কমবেশি আছে। ঢাকার মোহাম্মদপুরে রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা, গণভবনের সামনে, তেজগাঁও-গুলশান লিংক রোডসহ বেশ কিছু স্থানে ছাতিম ফুলের দূরবাহী প্রবল ঘ্রাণ রাতের শোভা বাড়িয়ে চলছে। রমনা পার্ক, বোটানিক্যাল গার্ডেনে তো আছেই।
বাংলার প্রকৃতিতে হেমন্ত অবশ্য পুরোপুরি ফুলের ঋতু নয়। দেবকাঞ্চন ও হিমঝুরি এই ঋতুর অন্যতম ফুল। এর মধ্যে হিমঝুরি তো দুষ্প্রাপ্য। গন্ধরাজ, মল্লিকা, রাজ-অশোক, বকফুল, কামিনী—এই ফুলগুলোর প্রস্ফুটন অন্য ঋতুতে হলেও হেমন্তেও তা ঢের থাকে। এখন হেমন্তে কদম ফুলও ফুটছে। ধানমন্ডির লেকের ধারে দেখা মিলছে কদমের। নানা রঙের গোলাপ তো সারা বছরই হয়। কাশফুল শরতের হলেও হেমন্তেও চোখে পড়ে। এ ছাড়া হেমন্তের শুরুতে বরইগাছে ফুল এলে মৌমাছির গুনগুনানি শুরু হয়ে যায়। ভারী মিষ্টি ঘ্রাণ এই বরই ফুলের। এ সময় বরইগাছের ডালে টুনটুনি ও চড়ুইয়ের ওড়াউড়ির দৃশ্য প্রকৃতি-অন্তপ্রাণ মানুষকে স্মৃতিকাতর করে তোলে।
হেমন্তে ফোটে কিছু অপ্রচলিত ফুলও। যেমন বামনহাটি, বনওকরা ও দণ্ডকলস। ঢাকার গ্রন্থাগার আন্দোলনের কর্মী ও সাংবাদিক ফাহিমা কানিজ জানান, সম্প্রতি গাজীপুরের কাপাসিয়ায় গিয়ে তিনি এই ফুলগুলোর দেখা পেয়েছেন। এর মধ্যে বামনহাটি ফুল সাদা, ডালের আগায় প্রায় দেড় সেন্টিমিটারজুড়ে বিস্তৃত পরিসরে ফোটে। নতুন ফুল লালচে রেখাযুক্ত, নলাকার, সাধারণত ৮ থেকে ১০ সেন্টিমিটার লম্বা ও রোমহীন। মোকারম হোসেন বলছিলেন, বামনহাটি দেশের চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, সিলেট, রংপুর ও টাঙ্গাইল জেলায় সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। ফুল ফোটার মৌসুম জুলাই থেকে অক্টোবর।
অপরদিকে বনওকরা বুনো গাছ। এটি রাস্তার ধারে, নদীর পাড়ে বা ঝোপঝাড়ে আগাছার মতো জন্মে। দেশের প্রায় সব অঞ্চলেই এ গাছের দেখা মেলে। নিসর্গী মৃত্যুঞ্জয় রায় জাতীয় সংসদ ভবনের পাশে চন্দ্রিমা উদ্যানে শরৎ-হেমন্তের দিনগুলোতে হাঁটতে গিয়ে বহুবার বনওকরার দেখা পাওয়ার কথা জানিয়েছেন। আর দণ্ডকলস বেশি দেখা যায় শর্ষেখেতে। ফুলটিতে আছে মধু। উপরিউক্ত তিনটি গাছেরই রয়েছে অনন্য ভেষজ গুণ।
হেমন্তের মাঠে মাঠে শিশিরের জল ঝরে। জীবনানন্দের ভাষায়, ‘বাঁশপাতা-মরা ঘাস-আকাশের তারা!/ বরফের মতো চাঁদ ঢালিছে ফোয়ারা!’ হেমন্তের সোনালি ধানের ঘ্রাণ, শিশিরবিন্দু, আকাশের তারা, চাঁদনি রাত আর এর ফুলের ঘ্রাণ প্রকৃতির সন্তানদের জীবনে মাধুর্য আনে।