রাজশাহীর একটি মুঠোফোন কোম্পানির টাওয়ার থেকে মা-বাবাসহ ধলাগলা মানিকজোড়ের ছবিটি তুলেছেন রাজশাহী ক্লাবের সভাপতি নাইমুল হাসান।

ধলাগলা মানিকজোড় বাংলাদেশের প্রাক্তন পরিযায়ী পাখি। উনিশ শতকে ঢাকা ও সিলেট বিভাগে পাওয়া যেত। এখন নেই, এটাই সবার জানা ছিল। কিন্তু রাজশাহীতে তিন-চার বছর ধরে চার-পাঁচ কিলোমিটারের ব্যবধানে মোবাইল কোম্পানির দুটি টাওয়ারে এরা বাসা বেঁধেছে।

এরই মধ্যে দুটি বাসায় তিনটি বাচ্চা ফুটিয়েছে। পাখিপ্রেমীদের মধ্যে ইতিমধ্যে এ খবর চাউর হয়ে গেছে। শুধু তা–ই নয়, বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা ইনাম আল হকও পরিদর্শন করে গেছেন পাখির বাসা। তাঁর মতে, প্রায় ১০০ বছর পর বাংলাদেশে এদের বাসা বাঁধতে দেখা গেল।

রাজশাহী বন বিভাগের বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের উদ্যোগে একটি টাওয়ারে ক্যামেরা বসানো হয়েছে। তাতে ধরা পড়ছে তাদের বিভিন্ন কার্যকলাপের ছবি।

ধলাগলা মানিকজোড়ের ইংরেজি নাম উলি নেকড স্টর্ক বা হোয়াইট নেকড স্টর্ক। বিশ্বে এই পাখি বিপদমুক্ত, তবে বাংলাদেশে বন্য প্রাণী আইনে এ প্রজাতি সংরক্ষিত। উপসাহারীয় আফ্রিকা ও ভারত থেকে ইন্দোচীন, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইনসহ এশিয়ার দক্ষিণাঞ্চলে এখন এদের বিস্তৃতি।

রাজশাহী বার্ড ক্লাবের সদস্য তারিক হাসান ২০১৮ সালে রাজশাহীতে মোবাইল কোম্পানির একটি টাওয়ারে ধলাগলা মানিকজোড়ের বাসা দেখতে পান। এই ক্লাবের সভাপতি নাইমুল হাসান এদের বেশ কিছু ছবি তুলেছেন। তিনি বলেন, বাংলালিংকের টাওয়ারে ধলাগলা মানিকজোড় প্রথমে একটি ডিম দেয়।

তখন কাকের উৎপাত শুরু হলে এরা পাশের রবির টাওয়ারে নতুন করে বাসা বেঁধে ডিম দেয়। সেখানে একটি বাচ্চা ফুটেছে। রাজশাহী বন বিভাগের বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের বন্য প্রাণী পরিদর্শক জাহাঙ্গীর কবির জানান, এ থেকে চার-পাঁচ কিলোমিটার দূরে বাংলালিংকের অপর একটি টাওয়ারেও তারা বাচ্চা ফুটিয়েছে। সেখানে তাঁরা ক্যামেরা বসিয়েছেন।

তাঁরা ছবিতে দেখছেন, ওই বাসায় তারা চারটা ডিম দিয়েছিল। এর মধ্যে দুটি ডিম ফুটে বাচ্চা উঠেছে। তিনি বলেন, এই টাওয়ারের চারপাশের বসবাসরত জনগোষ্ঠীকে এই পাখির গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন করা হয়েছে। পাখির নিরাপত্তার ব্যাপারে সোর্সের মাধ্যমে নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে।

বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের সহসভাপতি তারেক অণু ও এই প্রতিবেদক এক সন্ধ্যায় গিয়ে বাসায় এই পাখিদের উপস্থিতি দেখতে পান।

ধলাগলা মানিকজোড় সাদা গলা ও বাদামি চোখের জলচর পাখি। দৈর্ঘ্য ১০৫ সেন্টিমিটার, ডানা ৪৭ সেন্টিমিটার, ঠোঁট ১৫ দশমিক ৬ সেন্টিমিটার। পা ১৬ দশমিক ৫ সেন্টিমিটার ও লেজ ২৩ সেন্টিমিটার। প্রাপ্তবয়স্ক পাখির পিঠের অনেকটা কালোর ওপর সবুজ-নীল, বেগুনি ও তামার আভা; নরম লোমের মতো পালকে মোড়া ঘাড় সাদা, বুক কালচে।

পুরো ডানা কালো। মাথার চারদিকে এবং থুতনি ও গলার পালকহীন চামড়া অনুজ্জ্বল নীলচে কিংবা সিসা-ধূসর। বিভিন্ন মাত্রার লাল দাগসহ সোজা শক্ত ঠোঁট কালো এবং লম্বা পা ও পায়ের পাতা লাল। পুরুষ ও স্ত্রী পাখির চেহারা অভিন্ন। প্রাপ্তবয়স্ক পাখির পিঠ, ডানা ও বুক পালকময়। কপাল অনুজ্জ্বল বাদামি এবং ঠোঁট অনুজ্জ্বল লাল।

এরা পতিত জমি, প্লাবিত তৃণভূমি, জলা, বিচ্ছিন্ন কুঞ্জবনসহ নদীময় এলাকায় বিচরণ করে। সচরাচর এরা জোড়ায় কিংবা ছোট দলে থাকে। জলমগ্ন মাঠে হেঁটে কাদায় ঠোঁট ঢুকিয়ে এরা খাবার খায়।

খাদ্যতালিকায় রয়েছে কাঁকড়া, শামুকজাতীয় প্রাণী, ব্যাঙ ও সরীসৃপ প্রাণী। প্রায় শুকনা জলায় এরা বিচরণ করে। জালে আটকানো মাছ ও মাটি থেকে বেরিয়ে আসা পোকা শিকার করে। শীতের আবাসে সম্পূর্ণ নীরব থাকে।

কিন্তু গ্রীষ্মে ঠোঁট দিয়ে ঠকঠক শব্দ করে। জুন-জুলাই মাসে প্রজননকালে ভারতে পানির ধারে উঁচু গাছের ডালপালা ও খড় দিয়ে বিশালাকার মাচার বাসা বানিয়ে এরা ডিম পাড়ে। ডিমগুলো সাদা হয়। সংখ্যায় তিন থেকে পাঁচটি।

স্থানীয় পাখিপ্রেমীরা অনুরোধ জানিয়েছেন, এই টাওয়ারগুলোতে কাজ করার সময় যেন সচেতনভাবে পাখির বিষয়টি বিবেচনায় রাখা হয়।

আবুল কালাম মুহম্মদ আজাদ, রাজশাহী