সবুজে থাকি শ্যামলে বাঁচি
কালের চক্রে বছর আসে বছর যায়; কিন্তু কোনো কোনো বছর হয়ে ওঠে কালজয়ী, ইতিহাস। গত বছরটি ছিল তেমনই একটি বছর, জুলাই বিপ্লবে শুরু হয়েছে সংস্কারের শুভযাত্রা। সে যাত্রায় তাই বছরটি ঘিরে রয়েছে সাধারণ মানুষের অনেক আশা ও আবেগ। প্রত্যাশা, নানা রকম সংস্কারের মধ্যে এ দেশের প্রাণ-প্রকৃতিতেও ফিরে আসবে সুদিন, সবুজে–শ্যামলে আবার এ দেশ হয়ে উঠবে প্রকৃতই শ্যামল বাংলা।
এখনো ঢাকা শহরের একটি জায়গায় গিয়ে বড্ড শান্তি পাই। মন খারাপ হলে ছুটে যাই রমনা উদ্যান বা মিরপুরে জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানে। সবুজের কাছে গিয়ে যেন মন ভালো করার দাওয়াই পাই। রমনা উদ্যানের পুব দিকে হেয়ার রোডে এখনো অতীত রমনার সবুজ–শ্যামলিমার সাক্ষ্য দিচ্ছে শতবর্ষী কয়েকটি পাদাউক ও তেলশুরগাছ, রমনা উদ্যানের ভেতরে আছে শতবর্ষী কুসুম, বুদ্ধনারকেল, মেঘশিরীষ, বকুল ও মহুয়াগাছ। ঢাকা শহরে এমন ছায়াচ্ছন্ন সবুজের ছোঁয়া খুব কমই আছে। মোগল আামলেও তা ছিল।
আমাদের দেশটা সত্যিই সুন্দর, সবুজ–শ্যামলিমায় মাখা মায়াবতী এক দেশ। সে দেশের শ্যামলিমা উধাও হয়ে যাক, তা আমাদের কাম্য হতে পারে না। কিন্তু দুর্ভাগ্য হলেও সত্য, গত বছর দেশে বন উজাড়, বন দখল, বনে আগুন লাগা, গাছ কাটা, পার্ক ধ্বংস, মাটি কাটা, পাহাড় কাটা, পুকুর ভরাট, নদীর বালু তোলা, খাল দখল ইত্যাদি থেমে থাকেনি। এর সঙ্গে রয়েছে নানা রকমের পরিবেশদূষণকারী কাজ ইটভাটার ধোঁয়া, কলকারখানার বর্জ্য, যানবাহনের চলাচল ইত্যাদি।
সৌভাগ্য হলো, এ দেশের তেজোদীপ্ত তরুণেরাই আবার প্রতিবাদী হয়ে এগিয়ে এসেছেন প্রকৃতি রক্ষায়। মেট্রোরেলের ফার্মগেট স্টেশন করতে গিয়ে ধ্বংস হয়েছে শহীদ আনোয়ারা উদ্যান। সেটি জনগণকে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য আন্দোলনে নেমেছেন প্রকৃতিবাদীরা। পান্থকুঞ্জ পার্ক নষ্ট করে ঢাকার কারওয়ান বাজার থেকে পলাশী পর্যন্ত এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের র্যাম্প নামানো ঠেকাতে প্রতিবাদ করছেন তরুণেরা। আবার এ কথাও সত্য, এ দেশে গাছপালা ও বন ধ্বংসের অনেক ঘটনার কোনো প্রতিবাদও কেউ করেননি। জুন মাসে বরগুনার টেংরাগিরি বনের প্রায় আধা কিলোমিটার জায়গার গাছ কেটে নেওয়া হয়েছিল, আলামত লোপাট করতে কাটা গাছের গুঁড়িগুলো আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। অথচ কেউ এর প্রতিবাদ করেননি। বন দখল ও বনভূমি উজাড় হওয়ায় গত দুই দশকে দেশের সবুজে আচ্ছাদিত বনভূমি কমেছে প্রায় ৬ লাখ একর। এই বিপুল পরিমাণ বৃক্ষে আচ্ছাদিত এলাকা উজাড় না হলে বছরে অন্তত ৭৫ মেগা টন নিঃসরিত কার্বন শোষিত হতো। বন উজাড়ের পাশাপাশি রয়েছে বনভূমি দখলের ঘটনা। এরই মধ্যে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় আড়াই লক্ষাধিক একরের বনভূমি দখলকারী ১ লাখ ৬০ হাজার প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির তালিকা তৈরি করেছে বলে জানা গেছে। আশার কথা যে সম্প্রতি পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান অবৈধ দখলদারদের কাছ থেকে বনভূমি উদ্ধারের আশ্বাস দিয়েছেন। তবে তিনি শুধু একা নন, এ দেশের প্রাণ–প্রকৃতি রক্ষায় ও সবুজ–শ্যামলিমা উদ্ধারে এগিয়ে আসতে হবে সবাইকে। জনগণের অন্তর্ভুক্তিমূলক অংশগ্রহণ ছাড়া তা সফল হবে না।
নতুন বছরটি শুরু হলো অনেকগুলো নতুন আশা নিয়ে। এর একটি আশা ও অঙ্গীকার হোক সবুজের সঙ্গে থাকা, শ্যামলিমায় বাঁচা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের /‘নববর্ষ এল আজি’ কবিতায় শুনি সে আহ্বান, ‘যে জীবন বহিয়াছি/ পূর্ণ মূল্যে আজ হোক কেনা;/ দুর্দিনে নির্ভীক বীর্যে/ শোধ করি তার শেষ দেনা’।
নতুন বছরটা শুরু হোক গাছের কাছে আমাদের ঋণ শোধ দিয়ে। গাছপালাই আমাদের বাঁচিয়ে রেখেছে। তাই ওদের রক্ষা আমাদের বাঁচার জন্যই করতে হবে। আর এতে ব্যর্থ হলে তা হবে আমাদের আত্মহননের পথ।