আমাদের যত শুমচা পাখি 

ফকিরহাটের সাতশৈয়া গ্রামের একটি বাগানে খয়েরিমাথা শুমচা
ছবি: লেখক

বাস যখন সোনাডাঙ্গা টার্মিনালে এসে থামল, এক ফালি মিষ্টি রোদ ঘুমন্ত মুখের ওপর আছড়ে পড়ে ঘুমটা ভেঙে দিল। আলো ফোটার আগে পৌঁছানোর কথা থাকলেও খুলনা পৌঁছাতে পুরো তিন ঘণ্টা দেরি হলো। দ্রুত রূপসা ফেরিঘাটের দিকে ছুটলাম। ফেরি পার হয়ে টেম্পো ধরে ফকিরহাট বাজার। কিন্তু আকাশজুড়ে কালো মেঘের ঘনঘটায় মনটা খারাপ হয়ে গেল। সিঙ্গাতি পৌঁছামাত্রই শুরু হলো টিপ টিপ বৃষ্টি। বাজারে অপেক্ষা করছিলেন বিশিষ্ট পাখিবিশেষজ্ঞ শরীফ খান। ওনার সঙ্গে মিষ্টি ও গরম গরম পরোটার স্বাদ নিয়ে কিছুটা সময় পার করলাম।

বৃষ্টি থামল প্রায় এক ঘণ্টা পর। শরীফ খান, গাইড রবিউলসহ গ্রামীণ বাগানের দিকে হাঁটা দিলাম। বাগানে এসে রবিউলের নির্দেশিত বাঁশঝাড়সমৃদ্ধ একটি স্থানে চুপচাপ লুকিয়ে থাকলাম। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতেই মুখে খাবারসহ বাহারি রঙের ছোট্ট একটি পাখি পুরোনো আমগাছের ডালে এসে বসল। গাঢ় খয়েরি মাথার পাখিটির মুখমণ্ডল ও ঘাড়-গলা কালো; নীলের আভাসহ পিঠ জলপাই-সবুজ। বুক ও পেটের ওপরটা সবুজ, পেটের নিচ ও লেজতল আলতা লাল। ওখানে দুই ঘণ্টা ব্যয় করে তিনটি ছানাসহ বেশ কিছু ভালো ছবি তুললাম। 

পরের কয়েক দিনে শরীফ খানের গ্রামের বাড়ি সাতশৈয়ায় পাখিটির বাসা ও ছানাসহ প্রয়োজনীয় ছবি তুললাম ও গবেষণার তথ্য নিলাম। ২০১৩ সালের ঘটনা এটি।

পরের কয়েক বছর ছোট্ট বর্ণিল পাখিটির খোঁজ না নিলেও ওর দুটি জাত ভাইয়ের দেখা পেলাম গাজীপুর, রাজশাহী, বগুড়া ও সুন্দরবনে। সর্বশেষ একমুহূর্তের জন্য আরেকটি প্রজাতির দেখা পেলাম হবিগঞ্জের সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানে ২০১৯-এ; তবে ছবি তুলতে পারলাম না। 

সম্প্রতি গ্রীষ্মের প্রজনন পরিযায়ী পাখির খোঁজে মিরপুরে জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানে গিয়ে বর্ণিল পাখিগুলোর দুটি প্রজাতির সন্ধান মিলল। সঙ্গে থাকা কয়েকজন ছবি তুলতে পারলেও আমি ব্যর্থ হলাম।

এতক্ষণ বর্ণিল ছোট্ট যে পাখিগুলোর কথা বললাম, ওরা হলো শুমচা বা হালতি। দেহে নয়টি রঙের বাহারের কারণে ভারতে নওরং নামে পরিচিত। পিট্টিডি গোত্রের শুমচা খাটোলেজি পাখি। ইংরেজি নাম পিট্টা। বিশ্বব্যাপী চল্লিশটির বেশি প্রজাতির থাকলেও এ দেশে মাত্র পাঁচটি—দুটি আবাসিক ও তিনটি গ্রীষ্মের প্রজনন পরিযায়ী। অতিবিরল নীল শুমচা ছাড়া বাকি চারটির দেখা পেলেও ছবি তুলতে পেরেছি তিনটির।

সুন্দরবনের করমজলে সুন্দরী শুমচা
ছবি: লেখক

ফকিরহাটে দেখা সেই পাখিটি খয়েরিমাথা শুমচা বা ছোট হালতি। ইংরেজি নাম হুডেড পিট্টা। বৈজ্ঞানিক নাম Pitta sordida। যদিও দুর্লভ গ্রীষ্মের পরিযায়ী পাখিটি খুলনা বিভাগের গ্রামীণ বন এবং সিলেট ও চট্টগ্রাম বিভাগের মিশ্র-চিরসবুজ বনে প্রজনন ও বংশবৃদ্ধি করে, তথাপি অদ্যাবধি ফকিরহাটের বিভিন্ন গ্রাম ছাড়া কোথাও ওদের বাসা-ডিম-ছানার তথ্য পাওয়া যায়নি। পাখিটির মূল আবাস দক্ষিণ ও দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ার কিছু দেশ।

গ্রীষ্ম-বর্ষায় এ দেশের পত্রঝরা বন ও গ্রামীণ বন–বাগানে যে শুমচাটি বেশি দেখা যায়, সে হলো শুমচা, দেশি শুমচা বা সাদা হালতি। ইংরেজি নাম ইন্ডিয়ান পিট্টা। দুর্লভ প্রজনন পরিযায়ী পাখিটির বৈজ্ঞানিক নাম Pitta brachyura। ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, শ্রীলঙ্কাসহ দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশ থেকে গ্রীষ্মে ওরা এ দেশে আসে বংশবৃদ্ধি করতে।

দেশের তৃতীয় প্রজনন পরিযায়ী শুমচাটি নীল শুমচা বা ব্লু পিট্টা। বৈজ্ঞানিক নাম Pitta nipalensis। অত্যন্ত বিরল শুমচাটিও প্রজননের জন্য গ্রীষ্মে এ দেশে আসে দক্ষিণ ও দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশ থেকে। সিলেট ও চট্টগ্রাম বিভাগের মিশ্র-চিরসবুজ বনের ঝোপঝাড়ে বংশবৃদ্ধি করে।

বগুড়ার শাজাহানপুরের গ্রামে প্রজনন ডাকরত দেশি শুমচা
ছবি: লেখক

এ দেশের আবাসিক দুটি শুমচার মধ্যে সুন্দরবন ও আশপাশের জঙ্গলে যাকে দেখা যায়, সে সুন্দরী শুমচা বা সুন্দরী হালতি। দুর্লভ আবাসিক পাখিটির বৈজ্ঞানিক নাম Pitta megarhyncha। এ দেশ ছাড়াও দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে দেখা যায়।

দেশের দ্বিতীয় আবাসিক শুমচাটির নাম নীলঘাড় শুমচা, যা মূলত সিলেট ও চট্টগ্রাম বিভাগের মিশ্র-চিরসবুজ বনের ঝোপঝাড় ও বাঁশবনের বাসিন্দা। ইংরেজি নাম ব্লু-নেপড পিট্টা। দুর্লভ পাখিটির বৈজ্ঞানিক নাম Pitta nipalensis। বাংলাদেশ ছাড়াও দক্ষিণ ও দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে বাস করে। শুমচা দিবাচর ও সান্ধ্যচারী পাখি। সচরাচর একাকী বা জোড়ায় থাকে।