বাইক্কা বিলের রাজসরালি

মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গলের বাইক্কা বিলে রাজসরালি
ছবি: লেখক

দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে চলেছে। রোদের তেজও কমেছে কিছুটা। ক্যামেরা হাতে বাইক্কা বিল জলাভূমি অভয়ারণ্য থেকে বের হয়ে খানিকটা পেছনের দিকে হাঁটছি। সকালে বিলে ঢোকার আগে যে মৎস্য খামারটি পার হয়ে এসেছি, সেখানকার বড় পুকুরটিতে প্রচুর সরালি হাঁস ও অন্যান্য পাখি দেখেছিলাম।

ওখানে একটা ঢুঁ মেরে গেলে মন্দ হয় না। তাই পুকুরের পাড় ধরে হাঁটতে লাগলাম। সরালির বিশাল ঝাঁক। কোনো দল আকাশে উড়ছে, কোনোটা পানিতে ভেসে বেড়াচ্ছে। ওদের কলকাকলিতে মুখর পুরো পুকুর।

ওড়া ও ভাসা অবস্থায় ওদের কিছু ছবি তুলে ক্যামেরা নামিয়ে বাইনোকুলারে চোখ রাখলাম। পুরো পুকুরের আনাচে-কানাচে তন্নতন্ন করে খুঁজছি, নতুন বা দুর্লভ কোনো পাখি পাওয়া যায় কি না। খুঁজতে খুঁজতে একসময় সরালির ঝাঁকে অনেকটা ওদের মতোই দেখতে কিছুটা বড় আকারের কয়েকটি পাখির দেখা পেলাম। ঝটপট ছবি তুলে নিলাম।

মনে পড়ে গেল ১৯৯৬ সালের ৩০ ডিসেম্বরের কথা। সেদিন বাগেরহাট জেলার ফকিরহাট বাজারে আরও কিছু পরিযায়ী হাঁসের সঙ্গে এক পাখি বিক্রেতার কাছে এই একই প্রজাতির হাঁস দেখেছিলাম। ছবি তোলার পর পাখিটিকে নিয়ে বিল কোদালিয়ায় অবমুক্ত করেছিলাম।

ফকিরহাট বাজার ও বাইক্কা বিলের কাছে দেখা পাখিটির মাথা লালচে কমলা ও মাথার চাঁদি লালচে-বাদামি। ঘাড়ের পেছনে রয়েছে অস্পষ্ট কালো রেখা। লম্বা গলার মাঝখানটা সাদাটে ও তাতে কালচে দাগছোপ। পিঠ বাদামি-কালো। বুক-পেট-তলপেট তামাটে থেকে দারুচিনি রঙের। ডানার ওপরে অস্পষ্ট ডানা-ঢাকনি, বগলে সাদাটে ডোরা ও কোমরে সাদা ছিট থাকে।

চোখ বাদামি ও চঞ্চু ধূসর-নীল। পা, পায়ের পাতা ও নখ কালো। হাঁসা ও হাঁসি দেখতে একই রকম। অপ্রাপ্তবয়স্ক পাখির মাথার পাশ, ঘাড়ের ওপরের অংশ ও পিঠ হালকা খয়েরি। সদ্য ফোটা ছানার কোমল পালক ধূসর, দেহের নীচটা ফ্যাকাশে ও গলায় সাদা বন্ধনী। প্রাপ্তবয়স্ক হাঁসের দেহের দৈর্ঘ্য ৪৫ থেকে ৫৩ সেন্টিমিটার ও প্রসারিত ডানা ৮৫ থেকে ৯৩ সেন্টিমিটার। হাঁসা ও হাঁসির ওজন যথাক্রমে ৭৪৮ থেকে ১ হাজার ৫০ গ্রাম এবং ৭১৮ থেকে ১ হাজার গ্রাম।

ওরা নলবন ও উদ্ভিদপূর্ণ স্বাদুপানির অগভীর হ্রদ, বড় নদী, মোহনা, বিল ও হাওরে বড় দলে বিচরণ করে। প্রায়ই ছোট সরালির ঝাঁকের মধ্যে ওদের দেখা যায়। ভোরে ও রাতে বেশি সক্রিয় থাকে। পানিতে ঘন ঘন ডুব দিয়ে অথবা সাঁতরে জলজ কচি ঘাস, শস্যবীজ, মাছ, ব্যাঙ, গুগলি ইত্যাদি আহার করে। দিনের বেলা পানিতে, মাটিতে বা গাছের ওপর বিশ্রাম নেয়। পিঠের পালকের মধ্যে চঞ্চু গুঁজে এক পায়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। উচ্চস্বরে ‘নি-উই-উ—নি-উই-উ—-’ কণ্ঠে ডাকে।

জুন থেকে অক্টোবর প্রজননকাল। হাঁসা-হাঁসি সম্ভবত সারা জীবনের জন্য জোড় বাঁধে। প্রজনন মৌসুমে গাছের প্রাকৃতিক কোটরে, বড় শাখার ভাঁজে বা জলাভূমির কিনারায় ঘাসবনে লতাপাতার বাসা বানায়। হাঁসি ৬ থেকে ১০টি সাদা রঙের ডিম পাড়ে। হাঁসা-হাঁসি পালাক্রমে ডিমে তা দিলেও হাঁসিই বেশি সময় তা দেয়। অনেক সময় একই বাসায় ২ থেকে ৩টি হাঁসিকে ডিম পাড়তে দেখা যায়। কখনো কখনো অন্য হাঁসের বাসায়ও ডিম পাড়ে।

ডিম ফোটে ২৪ থেকে ২৬ দিনে। সদ্য ফোটা ছানাগুলো পালক শুকানো মাত্রই বাসা থেকে লাফিয়ে পানিতে পড়ে ও মা-বাবার সঙ্গে সাঁতরে চলে যায়। প্রায় দুই মাস বয়সে ওরা উড়তে শেখে। আয়ুষ্কাল ৫ থেকে ৬ বছর।

সরালির ঝাঁকে থাকা বড় পাখিগুলোকে ইতিমধ্যে বর্ণনা শুনেই হয়তো অনেকে চিনে ফেলেছেন। হ্যাঁ, ওরা এ দেশের সচরাচর দৃশ্যমান আবাসিক পাখি রাজসরালি। বড় সরালি, ফরালি হাঁস বা রামকোয়া নামেও পরিচিত। শীতে পরিযায়ী হিসেবেও বেশসংখ্যক হাঁস আবাসিক পাখিগুলোর সঙ্গে যোগ দেয়। ইংরেজি নাম Fulvous Whistling Duck। অ্যানাটিডি গোত্রের পাখিটির বৈজ্ঞানিক নাম Dendrocygna bicolor। বাংলাদেশ ছাড়াও এশিয়া, আফ্রিকা, ইউরোপ ও আমেরিকা মহাদেশের বহু দেশে ওদের দেখা যায়।

আ ন ম আমিনুর রহমান, পাখি ও বন্য প্রাণী চিকিৎসাবিশেষজ্ঞ