জীবন ফিরে পাওয়া ইগলের বাচ্চারা
এ বছরের ১ ফেব্রুয়ারি। খুব ভোরে শামীমের ফোন পেয়ে জেগে উঠলাম। খবর পেলাম টাঙ্গুয়ার হাওরের কালামপুর থেকে কুড়া ইগলের দুটি বাচ্চা চুরি হয়ে গেছে। চোরেরা বাচ্চাগুলো নিয়ে অটোরিকশায় করে সুনামগঞ্জের দিকে রওনা হয়েছে। এখনই যদি পুলিশ দিয়ে রাস্তায় পাহারা বসানো যায়, তাহলে বাচ্চাগুলো উদ্ধার করা সম্ভব। তখন আমি সুন্দরবনের একটি নৌকায়। এত সকালে কী করব, কিছুই মাথায় আসছিল না। প্রথমেই ফোন করলাম বন অধিদপ্তরের ক্রাইম কন্ট্রোল ইউনিটের সহকর্মী অসীম মল্লিককে। তিনি ব্যবস্থা নেবেন বলে আশ্বস্ত করলেন। একটু পরে অসীম জানালেন, তিনি সুনামগঞ্জের ওসিকে বলেছেন। তাঁর কথায় স্বস্তি পেলাম।
শামীম আমার দীর্ঘদিনের সহকর্মী। প্রায় দুই যুগ ধরে হাওরে আমার নৌকাচালক। এখন পাখি বিষয়ে খুব আগ্রহ নিয়ে কাজ করেন। শামীম একজন চোরের ফোন নম্বর সংগ্রহ করলেন। বুদ্ধি করে গিয়েছিলেন তাহেরপুরের একটি হোটেলে। সেই হোটেলটিতে আগের রাতে চোরের দল ছিল। একজনের ফোন নম্বর পাওয়া গেল হোটেল থেকে। তারপর আমি কল দিলাম তাকে। ফোনের অপর প্রান্তে একটি অচেনা কণ্ঠ আর অটোরিকশার শব্দ। লোকটিকে বললাম পাখিটিকে ফেরত দিতে। না হলে পুলিশের ভয় দেখালাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই তার ফোন বন্ধ পাওয়া গেল।
কুড়া ইগলের বাচ্চা চুরির ঘটনা এটিই আমার কাছে প্রথম। এ রকম ঘটনা আগে ঘটেছে কি না, জানি না। পৃথিবীব্যাপী বিপন্ন একটি ইগলের বাচ্চা চুরি হয়ে যাচ্ছে শুনে মনটা খারাপ। প্রায় আধা ঘণ্টা পর ইগলের বাচ্চা চোরকে আবার পাওয়া গেল। এবার তাকে অনেকক্ষণ বোঝালাম। পাখির বাচ্চাগুলোকে ফেরত দিতে বললাম। না হলে বাচ্চাগুলোর মারা যাওয়ার শঙ্কা আছে।
পাখির বাচ্চাগুলো অটোরিকশায় রেখে চোরের দল পালিয়েছে। শামীম অটোওয়ালার সন্ধান পেল। তাঁকে বুঝিয়ে ফেরত নেওয়া হলো তাহেরপুরে। দ্রুত নৌকা প্রস্তুত করা হলো কামালপুরে যাওয়ার জন্য। একজন পরিচিত গেছোকে নিয়ে শামীম গেলেন কামালপুরে।
কালামপুরের পরিস্থিতি আরও খারাপ। বাচ্চা পাখির মা-বাবা পুরো গ্রাম অস্থির করে ফেলেছে। যাকে পাচ্ছে তাকেই ছোঁ মারার চেষ্টা করছে। বাচ্চাগুলো ফিরে পেয়ে মা-বাবা বুকে জড়িয়ে ধরল। তাদের বাসায় দেওয়া হলো শোল মাছ। পাখিগুলোর হাহাকার কমল।
পালাসের কুড়া ইগলের এই কাহিনি আমার মনে দাগ কেটে গেল। সুন্দরবন থেকে ১ ফেব্রুয়ারি ফিরেই টাঙ্গুয়া যাওয়ার পরিকল্পনা করলাম। ১৪ ফেব্রুয়ারি বেলা তিনটার দিকে কামালপুরে পৌঁছালাম। দুটি বাচ্চাকে দেখলাম। মা-বাবা বাসা থেকে নড়ছে না। পাহারায় বসে আছে। কয়েকটি কাক খুব বিরক্ত করছিল। মূলত পাখিগুলো যে মাছ নিয়ে আসে, তা খাওয়ার জন্যই কাকগুলো সারাক্ষণ বিরক্ত করে। মা-বাবার যেকোনো একজন সব সময় বাসায় থাকে তা প্রতিহত করতে।
কুড়া ইগল একটি পরিযায়ী ইগল। মূলত শীতে এই ইগলগুলো আমাদের দেশে আসে মঙ্গোলিয়া ও তিব্বত অঞ্চল থেকে। এই পাখি নিয়ে আমি দীর্ঘদিন গবেষণা করছি বলে তার প্রায় সবকিছুই আমার জানা। আমাদের হাওর এলাকায় এরা প্রায় ৬-৭ মাস অবস্থান করে। বাচ্চা বড় হলে তাদের নিয়ে ফিরে যায় মঙ্গোলিয়ায়। এ যাত্রা শেষ করতে তাদের প্রায় ৩০ দিন সময় লাগে। এ সময় পাখিগুলো ২ হাজার ৮০০ কিলোমিটার ভ্রমণ করে।
কুড়া ইগল মঙ্গোলিয়ায় ভালো থাকলেও আমাদের দেশে এদের অবস্থা বেশ খারাপ। মূলত এদের বাসা করার জায়গার অভাব। সঙ্গে আছে খাবার আর বিদ্যুতের তারের সমস্যা। হাওর এলাকায় এখন বিদ্যুতের তারে ধাক্কা খেয়ে কুড়া ইগলের মৃত্যুহার অনেক বেশি। এ বছর হাওরের শুকাইরে এক জোড়া পাখি মারা গেছে বিষ মেশানো মাছ খেয়ে। একটি বাচ্চা মারা পড়ল বিদ্যুতের তারে বিদ্যুতায়িত হয়ে। এ রকম ঘটনা প্রায়ই ঘটছে।
এপ্রিল মাস অনেক কঠিন সময় ইগলের জন্য। বড় বড় ঝড় হয় এ সময়। বাচ্চাগুলো এ সময় ওড়া ও শিকার ধরা শেখে। ঝড়ে বাচ্চাগুলো মাটিতে পড়ে যায়। অবহেলায় বেশির ভাগ বাচ্চাই মারা যায়। এভাবে চলতে থাকলে হাওরের রাজাখ্যাত এ ইগলকে হারিয়ে যেতে দেখব।
লেখক, বন্য প্রাণী–গবেষক