সুন্দরবন থেকে পায়ে প্রচণ্ড ব্যথা নিয়ে ফিরেছি মাত্র তিন দিন আগে। এতই ব্যথা যে সপ্তাহখানেক বিশ্রাম প্রয়োজন। কিন্তু ঢাকার অদূরে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের পলাশপুরের এক পরিত্যক্ত আবাসন প্রকল্পে বিরল একটি পাখির আগমনের কথা শুনে ব্যথা ভুলে চলে গেলাম ধলেশ্বরীর পাড়ে।
প্রায় এক যুগ আগে পরিত্যক্ত হওয়া আবাসন প্রকল্পটির ভরাট করা বেলে মাটিতে তরতর করে বেড়ে উঠেছে নানা প্রজাতির কাষ্ঠল, ফলদ ও বুনো গাছপালা, ঝোপঝাড় এবং লতাগুল্ম। যেন চমৎকার এক গ্রামীণ বন! এক পাশে বিশাল আকারের মেঘশিরীষগাছের সারি। তার খানিকটা সামনে একটি ডকইয়ার্ড। পরিত্যক্ত এই আবাসন প্রকল্প বর্তমানে বহু প্রজাতির পাখি-প্রাণীর আশ্রয়স্থল। দিনের বেলায়ও এখানে শিয়ালের আনাগোনা।
পুরো এলাকায় ছোট-বড় ৮–১০টি শিমুলগাছ। বেশির ভাগ গাছেই টকটকে লাল ফুল। ফুলের রস পানের জন্য প্রচুর পাখির আগমন ঘটেছে। কাঠশালিক, হলদে পাখি, হাঁড়িচাঁচা, দাঁড়কাক, বুলবুলি, ছাতারে, বসন্তবাউরি, কাঠঠোকরা, শ্বেতাক্ষী আরও কত-কী? কিন্তু বহুক্ষণ শিমুলগাছের তলায় দাঁড়িয়ে থেকেও বিরল পাখিটির সন্ধান মিলল না। অসুস্থ শরীরে এত কষ্ট করে খোঁড়াতে খোঁড়াতে এসে খালি হাতে ফেরত যেতে চাইছি না। তাই গাছের নিচে দাঁড়িয়ে একদৃষ্টে শিমুল ফুলের দিকে তাকিয়ে রইলাম। প্রায় আড়াই ঘণ্টা পর হঠাৎই পাখিটি এল। কিন্তু অতিচঞ্চল পাখিটির অস্থিরতার কারণে ভালো ছবি তোলা গেল না। মাত্র কয়েক সেকেন্ড সময় দিয়ে পাখিটি চলে গেল। মনটাই খারাপ হয়ে গেল।
ক্যামেরা হাতে ধীরপায়ে ধলেশ্বরীর পাড়ে ছোট একটি শিমুলগাছের কাছে গেলাম। শিমুল ফুলে কাঠশালিকের ছবি তুললাম। বেলা প্রায় তিনটার সময় নদীর দিক থেকে তিরবেগে উড়ে এসে পাখিটি শিমুল ফুলে বসল। আর যায় কোথায়? ক্যামেরায় ক্লিকের বন্যা বয়ে গেল। তবে বেশিক্ষণ এখানে থাকল না। আগের সেই বড় গাছের দিকে উড়ে গেল। নদীর পাড় থেকে খোঁড়াতে খোঁড়াতে কোনোরকমে ওখানে পৌঁছালাম। শেষ পর্যন্ত শিমুল ফুলে ওর ভালো ছবি তোলা গেল। ঘটনাটি ২০২৩ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারির।
বিরল পাখিটি এ দেশের শীতের পরিযায়ী কালোগলা দামা। ইংরেজি নাম ব্ল্যাক-থ্রটেড থ্রাস। গোত্র তুরডিডি। বৈজ্ঞানিক নাম Turdus atrogularis। পূর্ব ইউরোপ থেকে পশ্চিম সাইবেরিয়া হয়ে উত্তর-পশ্চিম মঙ্গোলিয়া পর্যন্ত পাখি বিস্তৃত। শীতে দক্ষিণ, পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে পরিযায়ী হয়। একসময় লালগলা দামার একটি উপপ্রজাতি হিসেবে কালো গলা দামা গণ্য হতো। সম্প্রতি আলাদা প্রজাতি হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে।
প্রাপ্তবয়স্ক পাখির দেহের দৈর্ঘ্য প্রায় ২৫ সেন্টিমিটার ও ওজন ৭৩ গ্রাম। পুরুষের চিবুক থেকে বুক পর্যন্ত কালো। লেজ ধূসর-কালো। দেহের ওপরটা বাদামি-ধূসর ও নিচটা সাদাটে। ডানার নিচটা কমলা লাল। চোখ কালচে-বাদামি। চঞ্চু কালো, নিচের চঞ্চুর গোড়া হলদে। পা, আঙুল ও পায়ের পাতা হলুদাভ। স্ত্রী ও অপ্রাপ্তবয়স্ক পাখি দেখতে একই রকম। এদের গলা ও বুকে কালোর পরিবর্তে কালচে ছোপ থাকে।
শীতে পাখিটিকে সিলেট ও চট্টগ্রাম বিভাগের মিশ্র চিরসবুজ বন ও ঢাকা বিভাগের গাছপালাঘেরা এলাকায় দেখা যায়। সচরাচর মাটিতে বা গাছের চূড়ায় একা, জোড়ায় বা ছোট দলে বুক চিতিয়ে হেঁটে বেড়ায়। দ্রুত উড়তে পারে। বিভিন্ন ধরনের অমেরুদণ্ডী প্রাণী ও রসালো ফল খায়; ফুলের রসেও আপত্তি নেই। শীতে নীরব থাকলেও গ্রীষ্মে ‘কুই-ক্যাওয়া’, ‘চিপ্-চিপ্-চি-চি-চ্যেরর-ভোও’, ‘চ্যেরর-ভিইই’ বা ‘চেট-চেট-চেট’ শব্দে ডাকে।
মে থেকে জুলাই প্রজননকাল। এ সময় মূল আবাস এলাকার পাহাড়ের পাদদেশে বনে মাটি থেকে দেড় থেকে ২ মিটার উচ্চতায় গাছ, ঝোপঝাড় বা মাটিতে ঘাস ও সরু ডালপালা দিয়ে বাটি আকারের বাসা বানায়। বাসার বাইরের দিকটায় মস, লাইকেন বা কাদামাটির প্রলেপ থাকে। ডিম পাড়ে ৪ থেকে ৭টি; রং সবজেটে সাদা, তাতে থাকে মরচে-বাদামি ঘন ছিট-ছোপ। ডিম ফোটে ১১ থেকে ১২ দিনে। ১২ থেকে ১৩ দিন মা-বাবার আদরযত্ন পেয়ে ছানারা উড়তে শেখে। আয়ুষ্কাল ছয় বছরের বেশি।
আ ন ম আমিনুর রহমান: পাখি ও বন্য প্রাণী প্রজনন ও চিকিৎসাবিশেষজ্ঞ