ছাতিম ফুলের গন্ধ
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পথের পাঁচালীর অপু আর দুর্গাকে মনে আছে? ‘অপু বলিল, কি ফুলের গন্ধ বেরুচ্ছে, না দিদি? তাহাদের মা বলিল, তাহাদের জ্যেঠামশায়ের ভিটার পিছনে ছাতিম গাছ আছে, সেই ফুলের গন্ধ। তাহার পর সকলে গিয়া ঘুমাইয়া পড়ে। রাত্রি গভীর হয়। ছাতিম ফুলের উগ্র সুবাসে হেমন্তের আঁচলাগা শিশিরাদ্র নৈশবায়ু ভরিয়া যায়। মধ্যরাতে বেনুবনশীর্ষে কৃষ্ণপক্ষের চাঁদের ম্লান জ্যোৎস্না উঠিয়া শিশিরসিক্ত গাছপালার ডালে পাতায় চিকচিক করছে।’
ঢাকার মোহাম্মদপুরে রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজের ভেতরে একই জায়গায় এক জোড়া বড় ছাতিমগাছের মাথা ভরে থোকায় থোকায় ফুটে আছে হালকা সবুজাভ সাদা রঙের অসংখ্য ছাতিম ফুল। লাগোয়া গণভবনের সামনের সড়ক বিভাজকেও আছে একটি তরুণ ছাতিমগাছ।
সকালে পুবের নরম রোদে ফুলগুলো চিকচিক করছে। তবে রাস্তার ধুলোর প্রলেপে পাতাগুলো বড্ড মলিন। জলবায়ু পরিবর্তনে এখন হেমন্তেও শিশির পড়েনি পাতায় পাতায়। তবে পথের পাঁচালীর বর্ণনামতো শিশিরাদ্র ছাতিমের দেখা পেয়েছিলাম কয়েক বছর আগে বরিশাল শহরের বঙ্গবন্ধু পার্কের ভেতরে। সেদিনও ছিল হেমন্তকাল।
প্রকৃতির কি এক অদ্ভুত খেলা! রাতে যে ফুলের এত গন্ধ, সকালেই তা কি করে কর্পূরের মতো উবে যায়! আবার নিশি শেষে বাসি ফুল থেকে ভেসে আসে তীব্র ঝাঁজালো গন্ধ, সে গন্ধে মাথাটা ঝিমঝিম করে। কাল রাতে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় ছাতিমের মাতাল করা গন্ধে মনটা উতলা হয়ে উঠেছিল ওকে দেখার জন্য। সকালে ফিরে এলাম সে পথে। দেখা হলো ছাতিমের সঙ্গে। কিন্তু সে গন্ধ কই? তবে ফুলের স্ফুরণ দেখে মনটা ভরে গেল। কোন গাছে এত ফুল ফোটে!
কদম যেমন বর্ষার দূত, ছাতিম তেমন হেমন্তের। এবার দেখলাম ঢাকা শহরে পথতরু হিসেবে বেশ কিছু ছাতিমগাছ লাগানো হয়েছে। ছাতিমগাছ খুব দ্রুত বাড়ে। তিন-চার বছরের মধ্যেই গাছগুলো পথচারীদের ছাতার মতো ছায়া দিতে পারবে। গত বছর কবি নজরুল পার্কে তিনটি ছাতিমগাছ লাগিয়েছিলাম। এ বছর দেখলাম সেগুলো অনেক বড় হয়ে ডালপালা ছাড়তে শুরু করেছে। প্রাচীনকালে ছাতিমগাছের কদর ছিল। টোল বা পাঠশালার প্রাঙ্গণে ছাতিমগাছ লাগানো হতো।
শিক্ষক ছাত্রদের নিয়ে সেই ছাতিমগাছের ছায়াতলে বসে পাঠদান করতেন। এ ছাড়া এর কাঠ দিয়ে বানানো হতো ব্ল্যাকবোর্ড। চকপেনসিল দিয়ে সে ব্ল্যাকবোর্ডে লেখা হতো। এ জন্যই কিনা জানি না, এর উদ্ভিদতাত্ত্বিক নামের অংশ হিসেবে যুক্ত রয়েছে লাতিন স্কলারিস শব্দটি। ছাতিমের উদ্ভিদতাত্ত্বিক নাম Alstonia scholaris, গোত্র অ্যাপোসাইনেসি। এর একটি পত্রদণ্ডে থাকে সাতটি পাতা। এ জন্য এর আরেক নাম সপ্তপর্ণী।
একালে ছাতিমের প্রয়োজন হয়তো ফুরিয়েছে, কেউ আর এখন ব্ল্যাকবোর্ডে লেখে না। তাই এর কাঠের দরকার হয় না। সচরাচর ছাতিমগাছ কেউ লাগায় না। তবু সারা দেশে বিক্ষিপ্তভাবে ছাতিমগাছ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে।
এর কারণ, ছাতিমগাছের বীজের বাতাসে ভেসে চলার অদ্ভুত ক্ষমতা। ছোট কাঠির মতো বীজের সঙ্গে প্রান্তে থাকে পশমের মতো অঙ্গ। ফল ফেটে বীজ বাতাসে ছড়িয়ে পড়লে তা বাতাসে ভেসে ভেসে অনেক দূরে চলে যায়। সুবিধামতো জায়গায় পড়লে সেখানেই ছাতিমগাছ গজিয়ে ওঠে।
মৃত্যুঞ্জয় রায়, কৃষিবিদ ও প্রকৃতিবিষয়ক লেখক