সৌরভ ছড়ানো ‘গোলাপ গ্রাম’

মাঘের প্রকৃতিতে রং ছড়িয়ে ফুটে আছে গোলাপ। সাভারের সাদুল্লাহপুরে
ছবি: প্রথম আলো

গোলাপ গ্রামে ঢোকার মুখেই জীবনের নানা আয়োজন। গ্রামীণ সড়কের দুপাশে ছোট ছোট ফুলের দোকান। গোলাপ তো আছেই, গ্ল্যাডিওলাস, চন্দ্রমল্লিকা, জারবেরা, রজনীগন্ধা, আরও কত ফুল। ফুল কিনছেন অনুরাগীরা, কাছে গিয়ে ঘ্রাণ নেওয়ার চেষ্টা কারও কারও। কেউ হরেক রকমের ফুলের তৈরি মুকুট পরে কলহাস্য করছেন। ক্যামেরায় বন্দী হচ্ছে দৃশ্যের পর দৃশ্য। ভরদুপুরে মাঘের প্রকৃতিতে ভিন্ন রকম আনন্দের রং।

এসেছি গোলাপ গ্রামে। তারিখ ২০ জানুয়ারি, শুক্রবার। ঢাকার মিরপুর বেড়িবাঁধ সড়ক ধরে বিরুলিয়া হয়ে এই গোলাপ গ্রাম। আদতে, মানে দাপ্তরিক কাগজপত্রে গোলাপ নামে কোনো গ্রাম নেই। কিন্তু এখানকার সাধারণের মুখের কথায়, দোকানের সাইনবোর্ডে—সবখানে আছে ‘গোলাপ গ্রাম’। ঢাকার সাভারের বিরুলিয়া ইউনিয়নের শ্যামপুর, সাদুল্লাহপুর, মৈস্তাপাড়া, বাগ্নিবাড়ি, বাটুলিয়া ও কমলাপুর গ্রাম ফুল চাষের জন্য পরিচিত। উঁচু মাটির এই গ্রামগুলো একনামে খ্যাত গোলাপ গ্রাম নামে।

গ্রামে ঢোকার মুখে পাওয়া যায় টাটকা সবজি
ছবি: প্রথম আলো

রাজধানীর মানুষ এখানে আসেন বুকভরে খানিকটা অক্সিজেন নিতে। তা এদের চাঞ্চল্য আর মুখরতা দেখলেই বোঝা যায়। নারীদের বেশির ভাগই এসেছেন গোলাপের রঙের সঙ্গে মিলিয়ে শাড়ি পরে। পুরুষেরাই–বা কম যাবেন কেন? তাঁদের পাঞ্জাবিতেও আছে প্রকৃতির নানা রং। কদিন পরেই ১৪ ফেব্রুয়ারি, বিশ্ব ভালোবাসা দিবস। তাই কাটা পড়বে বেশির ভাগ ফুল। এ জন্যই বোধ করি এখন গোলাপ গ্রামে ভিড় এতটা।

গোলাপ গ্রামে ঢোকার মুখে স্বাগত জানাল তাজা ফুলকপি। রাস্তার এক পাশে খানিকটা জায়গা নিয়ে ফুলকপি, দেশি ছোট পেয়ারা, টক বরই, ধনেপাতা, কামরাঙা, বেগুন, শিম নিয়ে বসে গেছেন বিক্রেতারা। ফুলকপিগুলো এতটাই সাদা ও তাজা, দেখলে মনে হতে পারে সদ্য গোসল সেরে উঠেছে। ২৫ টাকা পিস দরে চারটি কিনে নিলাম দেরি না করেই।

বিপরীত পাশে রেস্তোরাঁ—‘কিছুক্ষণ’। দুপুরে খাওয়ার আয়োজন কী? জানতে চাইলে নারী ব্যবস্থাপক বললেন, গরম ভাতের সঙ্গে হাঁসের মাংস, দেশি মুরগির মাংস, নতুন আলু দিয়ে ছোট ট্যাংরা মাছের ঝোল, কাঁচা মরিচ দিয়ে ছোট বেলে মাছের চচ্চড়ি। আর আছে মুরগি দিয়ে পোলাওর চালের খিচুড়ি। কোনো গুঁড়া মসলার ব্যবহার নেই, আদা-হলুদ-ধনে-জিরা-মরিচ সব বেঁটে রান্না করা হয়।

তখন দুপুর ১২টা বাজে মোটে। ঠিক খাওয়ার সময় হয়নি। তাই সামনে এগোতে থাকি। একটু পরপর ছোট ছোট ফুলের দোকান। খেত থেকে ফুল তুলে দোকানে সাজানো হচ্ছে। গোলাপ প্রতিটি খুচরোয় ১০ টাকা।

প্রতিটি ফুলবাগানের মুখে একটি করে দোকান। কোনো পর্যটক যদি এই দোকান থেকে ২০টি ফুল কেনেন, তবে তিনি বা তাঁরা বাগানের ভেতরে ঢুকে ছবি তুলতে পারবেন। আর যদি না কেনেন, তবে ভেতরে ঢুকতে পারবেন না, এই হলো নিয়ম।

সরকারি হিসাবমতে, বিরুলিয়ার গ্রামগুলোয় ৩৫০ হেক্টর জমিতে ফুলের চাষ হয়। আর এর সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন প্রায় দেড় হাজার চাষি। গোলাপ বিক্রির জন্য শ্যামপুর ও মৈস্তাপাড়ায় গড়ে উঠেছে ফুলের বাজার। চাষিরা বাগান থেকে ফুল তুলে বিকেলের মধ্যেই বাজারে নিয়ে যান। সন্ধ্যা ৭টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত চলে ফুল বেচাকেনা। স্থানীয় ফড়িয়ারা দুই বাজার থেকে ফুল কিনে সরাসরি রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে নিয়ে বিক্রি করেন। ইদানীং জারবেরার চাষ বেড়েছে, গোলাপ থেকে নাকি এতে লাভ বেশি।
পুরো পথের দুপাশে কোথাও বিক্রি হচ্ছে গরম জিলাপি, পেঁয়াজু, দানাদার, খাজা-গজা, মুড়ি-মুড়কি। বোতলজাত পানি, কোমল পানীয়, রংচা, দুধ চা—এসব তো আছেই।
যাঁরা বেড়াতে এসেছেন, কেউ দোকানের পাটাতনে, কিংবা সামনে পাতা বেঞ্চে বসে বিশ্রাম নিচ্ছেন। কেউবা বসেছেন ঘাসের ওপর ঘর থেকে আনা চাদর পেতে। বাচ্চাকাচ্চাদের নানা বায়না মেটাতে হিমশিম খাচ্ছেন মা–বাবারা।

হাঁটতে হাঁটতে অনেক দূর চলে যাই। তিনটি গ্রাম পেরিয়ে এসেছি। কোথাও কামিনীগাছের মাথায় লাউয়ের ডগা চেপে বসেছে, কোনো খেতে ঝুলে আছে অগুনতি লাউ, কোথাও দিগন্তজোড়া মুলাখেত, ফুল এসেছে, মধুপানে ব্যস্ত নাম না–জানা পতঙ্গ।
একটি বাগানের সামনে ফুলের পাশাপাশি ছোট্ট টেবিলে কিছু পেয়ারাও বিক্রি করছেন এক তরুণ। চেহারায় ঠাটবাট। পেয়ারা প্রতিটি ২০ টাকা। একজন ক্রেতা বললেন, ‘কেজি কত নেবেন?’ জবাবে তরুণটির উত্তর, ‘ধুর মিয়া আপনার কাছে বেচবই না। দেশি জিনিস কেজিতে বিক্রি হয় না।’ সেই লোক চলে যেতেই চারটি পেয়ারা কিনলাম। তরুণটির রাগ তখনো যায়নি, ‘আমারে মনে করছে কামলা। সাভার কলেজ থেকে মাস্টার ডিগ্রি পাস করছি।’

বিরুলিয়া ইউনিয়নের দক্ষিণে শেষ গ্রামটির নাম কমলাপুর। বোরো খেতে কাজ করছেন বছর পঞ্চাশের মো. মুসলিম, পুরোদস্তুর কৃষক। ছেলেও তা–ই। ফল-ফসল বিক্রি করতে যান মিরপুরের পাইকারি বাজারে। মুসলিম জানালেন, এলাকায় জমি বিক্রি হচ্ছে দেদার। কোম্পানিগুলো কিনে নিচ্ছে। ঢাকায় বসেই সব বিক্রি হয়ে যাচ্ছে।
পুরো পথটি হেঁটে এসে তাই বিষণ্ন হয়ে পড়ি। এই পথটি অমুক কোম্পানির নিজস্ব। প্লট বুকিং দিলেই ৫৫ ইঞ্চি টেলিভিশন ফ্রি—এ রকম ‘লোভনীয়’ বিজ্ঞাপন। জায়গায় জায়গায় মাটি কেটে ‘গভীর গিরিখাদ’ বানিয়ে রাখা হয়েছে।

এত সুন্দর গোলাপ বাগানগুলোর ভবিষ্যৎ অন্ধকার। হয়তো ছোট ছোট প্লটে ভাগ হয়ে যাবে ফুলের খেত। মো. মুসলিমের কথায়ও তা স্পষ্ট, ‘বাগান হয়তো থাকবে, তবে এত বড় করে নয়।’

যেভাবে আয়োজন চলছে, শিগগিরই এলাকাটি শহর হবে। মানুষ ভুলে যাবে, এখানে একদিন পল্লির ছোট্ট কুটির ছিল, ছিল লাউখেত, ফুলের বাগান, ছিল মেঘের স্পর্শ নেওয়া তালগাছ, বটের ঝুরি।

কবি জীবনানন্দ দাশ যেমন লিখেছিলেন, ‘অশ্বত্থ বটের পথে অনেক হয়েছি আমি তোমাদের সাথী;/ ছড়ায়েছি খই ধান বহুদিন উঠানের শালিখের তরে;/ সন্ধ্যায় পুকুর থেকে হাঁসটিরে নিয়ে আমি তোমাদের ঘরে/ গিয়েছি অনেক দিন, — দেখিয়াছি ধূপ জ্বালো,  ধরো সন্ধ্যাবাতি’, তখন তেমনি হয়তো কোনো কবি তাঁর কবিতার খাতায় লিখবেন এমনই কিছু পঙ্‌ক্তি।