বাড়িজুড়ে দুর্লভ গাছ

গাছের শরীরজুড়ে ফুটে আছে নাগলিঙ্গম ফুল
ছবি: প্রথম আলো

গ্রামের মাটির পথে ঢুকতেই রূপসী বাংলা আর জীবনানন্দ দাশকে মনে পড়ে যায়—‘...চারিদিকে চেয়ে দেখি পল্লবের স্তূপ/ জাম—বট—কাঁঠালের—হিজলের—অশথের ক’রে আছে চুপ;/ ফণীমনসার ঝোপে শটিবনে তাহাদের ছায়া পড়িয়াছে!’ কবিতার পঙ্‌ক্তির মতোই গ্রামজুড়ে শীতল ছায়া।

মাঝেমধ্যে এক-দুই টুকরা রোদের ঝিলিক। পথের দুই পাশে অনেক রকম গাছপালা, বাঁশঝাড় আর শটিবন মমতার ভাইবোন হয়ে জড়াজড়ি করে আছে। গ্রামটির নাম শহরশ্রী, পুরোটাই সবুজে-শ্যামলে মাখা। ওখানে শহরের অনেক কিছু পৌঁছেছে হয়তো, কিন্তু শহরশ্রী শহর হয়ে উঠতে মনে হয় আরও কিছুটা সময় নেবে।

শহরশ্রী মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল উপজেলার মীর্জাপুর ইউনিয়নের একটি টিলাভূমির গ্রাম। ধুলা, লালচে কাদামাটির পথ ধরে একটি বাড়িতে ঢুকতেই চোখের সামনে আরও এক বিস্ময় খেলা করে। একটি গাছের শরীর জড়িয়ে আছে যেন হাজার প্রজাপতি। তাদের ডানায় স্থির মেঘের রং, শান্ত উল্লাস। ঝরা পালকের মতো টুপ টুপ করে দু-একটি পাপড়ি ঝরে পড়ছে। প্রায় ৮০ ফুট উঁচু গাছটির নিচটা যেন পাপড়ির মাদুর বিছানো। গাছটির গোড়া থেকে ওপর পর্যন্ত একা, গুচ্ছ হয়ে কাণ্ডের মধ্যে ঝুলে আছে অনেক ফুল।

শরীরে কাঁটা নিয়ে দাঁড়িয়ে বাদরংগাছ
ছবি: প্রথম আলো

বাড়ির মালিক অবসরপ্রাপ্ত নৌ কর্মকর্তা দেওয়ান গউছউদ্দিন আহমদ জানালেন, প্রায় ৫০ বছর আগে তাঁর বড় ভাই অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংক কর্মকর্তা দেওয়ান মহীউদ্দিন আহমদ নার্সারি থেকে একটি ফুলের চারা এনে বাড়িতে রোপণ করেন। গাছটি কী জাতের, তাঁরা চিনতেন না। ধীরে ধীরে গাছটি বড় হয়েছে। কয়েক বছর পর গাছটিতে ফুল এসেছে। গাছের শরীর ফুঁড়ে নজরকাড়া ফুল দেখে তো তাঁদের চোখভরা মায়ার ঘোর।

তখনই খোঁজখবর নিয়ে জানতে পারেন, এটি হচ্ছে নাগলিঙ্গম ফুলের গাছ। বৈশাখ মাসে ফুল ফুটতে শুরু করে, ভাদ্র মাস পর্যন্ত ফোটে। হাজারো ফুলে গাছটি তখন রঙিন হয়ে যায়। সকালে এই ফুল থেকে মিষ্টি একটা গন্ধ বেরিয়ে আসে। ওই গাছের পাশে প্রাকৃতিকভাবে আরও দুটি গাছ উঠেছে। এখনো ফুল আসেনি। গাছটির কাছেই দেখা হওয়া মৌলভীবাজারের অন্যতম সাংস্কৃতিক সংগঠক সৈয়দ আবদুল মোতালিব রঞ্জু জানালেন, তিনি ২০১৭ সালে একবার নাগলিঙ্গমের ফুল দেখতে এ বাড়িতে এসেছিলেন। এবারও অনেক ফুল ফুটেছে জেনে দেখতে এসেছেন।

তবে বাড়িটি শুধু নাগলিঙ্গমেই পৃথক পরিচয় পেয়েছে, এমন নয়। আরও দুর্লভ, বিলুপ্তপ্রায় অনেক গাছ শত বছরের বেশি সময় ধরে টিকে আছে, ফুলে-ফলে আনন্দ উদ্‌যাপন করছে। বাদরং নামে একটি গাছ আছে, ২৫-৩০ ফুট উঁচুতে উঠে ডালপালা মেলেছে। গাছটির শরীরে বেশ বড় কাঁটাভরা বাকল। কাছাকাছি তিনটি গাছ। থোকায় গোটা গোটা ফল ধরে।

এই ফল থেকে তেল হয়। একসময় বাদরঙের ফলের তেল দিয়ে রান্নাবান্না হয়েছে, এমনটাই বললেন বাড়ির মালিক ও উপস্থিত অন্যরা। গাছটি খুব শক্ত। বাড়েও খুব ধীরে। একটি কাঁঠালগাছের ৮-১০ ফুট উচ্চতার গোড়া বহুকালের পোড় খাওয়া শরীর নিয়ে দাঁড়িয়ে।

কাঁঠালগাছটি কোনো ঝড়ে ভেঙে পড়েছে, এরপর গোড়াটিকে সযত্নেœলালন করা হচ্ছে। যাতে আরও বহুকাল টেকে। গাছটি বাড়ির সমান বয়সী। দেওয়ান গউছউদ্দিন বাড়ি ও গাছটির বয়স জানালেন প্রায় ৪০০ বছর। বাড়ির দলিল-দস্তাবেজ থেকেই বাড়ির বয়সটা সম্পর্কে এমন ধারণা উত্তরাধিকারদের।

প্রাচীন বিশাল এক জামের গাছ আছে বাড়ির একটি অংশে। তার ডালপালা ছাতার মতো অনেকখানি জায়গাজুড়ে ছড়িয়ে। মৌসুম এলেই ছোট ছোট জামে ভরে ওঠে শাখা-প্রশাখা। একটি তালগাছ, যার বয়স প্রায় দেড় শ বছর। আছে বিলুপ্তপ্রায় ডেউয়া, কাউ, গাব, কাউফল, মনফল, চাউর। আছে উলটকম্বল, হরীতকী, বহেড়া, অর্জুন, চাপালিশ, দারুচিনি, লুকলুকি, ধূপগাছ। দেখা পাওয়া গেছে টেন্ডুপাতার গাছের। ওই পাতা দিয়ে তৈরি করা হয় বিড়ি। অনেকটা গাবের মতো ফল ধরে।

ফলটি বন্য প্রাণীদের বেশ প্রিয়, পাকার আগেই সাবাড় করে ফেলে তারা। আম, জাম, কাঁঠালসহ দেশীয় অনেক জাতের গাছ তো আছেই, তেমনি অচেনা গাছেরও কমতি নেই। এসব অচেনা গাছের কোনোটি হয়েছে প্রকৃতির নিয়মে, কোনোটি নামধাম না জেনেই বাড়ির কেউ না কেউ লাগিয়েছিলেন।

দুর্লভ, বিরল ও অচেনা গাছগুলোকে না কেটে যুগ যুগ ধরে রক্ষা করা হচ্ছে। চেনা জাতের গাছের সঙ্গে নতুন করে লাগানো হচ্ছে বিলুপ্তপ্রায় আরও অনেক গাছ। পুকুরে ফুটছে লাল শাপলা।

এ রকম একটি বাড়ি, একটি শহরশ্রী গ্রামের ধুলামাখা পথ ঘুরে কারও মনে আসতেই পারে—‘বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি, তাই আমি পৃথিবীর রূপ/ খুঁজিতে যাই না আর।’