হাওরের দুই ফুল নিয়ে কথা 

সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওরের বনপুদিনা ও মোটামাথার লালমুখো ফুলছবি: লেখক

শুষ্ক মৌসুমে সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলা থেকে বাইকে চেপে সোলেমানপুর বাজার গিয়ে সেখান থেকে নৌকায় টাঙ্গুয়ার হাওরে যেতে হয়। তখন দুই পাশের দৃশ্য হৃদয়ছোঁয়া, মায়াময়। মুগ্ধতার মাত্রা এতই বেশি থাকে যে পুরো সময়টা ঘোরের মধ্যে কেটে যায়। নদী, খাল পেরিয়ে যেতে যেতে চারপাশ ক্রমেই নির্জন হয়ে ওঠে। হিজল, করচ, বরুণের দীর্ঘ সারি। ঘাসবনে হুরহুরি ফুলের বেগুনি আভা চমকে দেওয়ার মতো। পাশেই ঢালু অংশজুড়ে বিচিত্র লতাগুল্মের ঠাসবুনন। এরই মধ্যে আরও অনেক ফুল ও তৃণগুল্মের ভেতর থেকে নিজেদের জোরালো অবস্থান জানান দিচ্ছিল বনপুদিনার ঝাড়। বনপুদিনা আর হুরহুরির ছবি তুলতে গিয়ে পেয়ে গেলাম টুকটুকে লালমুখো একগুচ্ছ ফুল। এই দুই ফুল নিয়েই এখন সংক্ষিপ্ত আলাপচারিতা।

বনপুদিনা বা মটমটিয়া দেশের অধিকাংশ জলাশয়েই সহজদৃষ্ট। এমনকি পাহাড়ের ঢালুতেও চোখে পড়ে। তবে হাওরের গাছগুলোর সঙ্গে অন্যান্য স্থানের গাছগুলোর মৌলিক তফাত হলো, সেখানকার গাছগুলো বর্ষা মৌসুমে ছয় থেকে সাত মাস পানির নিচে জীবন্ত অবস্থায়ই ডুবে থাকতে পারে। পানি সরে গেলে আবার পুষ্পপল্লবে সুশোভিত হয়ে ওঠে।

বনপুদিনাকে প্রথম দেখায় ভুলবশত ল্যান্টানাও মনে হতে পারে। কারণ, গড়নের দিক থেকে ল্যান্টানার সঙ্গে বেশ সাদৃশ্যপূর্ণ। বান্দরবানের মেঘলা পর্যটনকেন্দ্রে বেড়াতে গিয়ে পাহাড়ে জন্মানো বনপুদিনার বিশেষ সৌন্দর্য আলাদাভাবে দেখার সুযোগ হয়। পাহাড়ের ঢালে অসংখ্য ফুলের মেলা। কারুকার্যময় সবুজ পাতার পটভূমিতে গোলাপি আভার ফুলগুলো আলো ছড়াচ্ছিল। গাছটি অনেক বৈরী পরিস্থিতির মধ্যেও বেঁচে থাকতে পারে। বর্ষায় ডুবে থাকার সময় মটমটিয়া বা বনপুদিনার ঝোপে ছোট মাছের বেশ আড্ডা জমে। কারণ, ঝোপে জমা শেওলা তাদের অন্যতম খাবার। বাকলের ঘ্রাণ চিংড়ি মাছের প্রিয়।

বনপুদিনা (Lippia alba) ঝোপজাতীয় গাছ। ডালপালা ও কাণ্ড নরম, ভাঙার সময় মট করে শব্দ হয় বলেই সম্ভবত এমন নামকরণ। পাতা আয়তাকার, ঝাঁজালোগন্ধি, কিনারা করাতের মতো। বিপরীতমুখী দুই পাতার কোলে ফুল ফোটে, পাপড়ির সংখ্যা ৪ থেকে ৫, নীলচে গোলাপি রঙের মাঝখানে হলুদের ছিটা। শীত ও বর্ষায় বেশি ফোটে। বাংলার বনফুল গ্রন্থে নওয়াজেশ আহমদ জানিয়েছেন, পাতার রস পেটের অসুখ ও নার্ভের টনিক হিসেবে কাজে লাগে। কেউ কেউ বেড়া তৈরিতেও কাজে লাগান। আসামে পাতা সবজি হিসেবে খাওয়ার প্রচলন রয়েছে। গ্রামে গাছের ধোঁয়া মশা তাড়ানোর কাজে ব্যবহার করতে দেখা যায়।

সবুজ ঢাকনায় মোড়ানো লালমুখো ফুলগুলো গড়নের দিক থেকে অনেকটাই ব্যতিক্রম। পরিণত ফুলগুলো ফলে রূপান্তরিত হলে তুলার মতো ছড়িয়ে পড়ে। ফলের সাদা চুলের মতো এমন ভাসমান রূপকে ভারতের শিশুরা ‘বৃদ্ধ মহিলা’ নামে সম্বোধন করে। কিন্তু আমাদের দেশে গাছটির স্থানীয় কোনো নাম পাওয়া গেল না। ইংরেজি নামের মধ্যে থিকহেড, ফায়ারউইড ও রেডফ্লাওয়ার র‌্যাগলিফ অন্যতম।

থিকহেড (Crassocephalum crepidioides) বা মোটামাথার এই ফুলের গাছ ৭০ থেকে ৮০ সেন্টিমিটার উঁচু হতে পারে। এটি মসৃণ বা সূক্ষ্ম লোমযুক্ত একটি খাড়া ও ছোট শাখাযুক্ত বর্ষজীবী। কাণ্ড মাকড়সার জালসদৃশ, সরল বা শাখা বিন্যাসিত। পাতা উপবৃত্তাকার, সবৃন্তক বা অর্ধবৃত্তক, পত্রফলক ২ থেকে ১৪ সেন্টিমিটার, নিম্নাংশে ক্রমান্বয়ে সরু ও ১ থেকে ২ জোড়া। ফুল ফোটে কাণ্ডের শীর্ষে, অনূর্ধ্ব ৮ সেন্টিমিটার লম্বা, মঞ্জরি বেলনাকার বা কলসের মতো। মঞ্জরিপত্র বল্লমের মতো, এক থেকে চার মিলিমিটার লম্বা, মুক্ত ও ফ্যাকাশে সবুজ। ফুলের রং গাঢ় কমলা, কখনো কখনো গোলাপি থেকে কমলা-হলুদও হতে পারে। দলমণ্ডল খণ্ডবিশিষ্ট, অনূর্ধ্ব ৯ মিলিমিটার লম্বা। ফুল ও ফলের মৌসুম সেপ্টেম্বর থেকে মে মাস পর্যন্ত বিস্তৃত। এই গাছ বর্তমানে পৃথিবীর গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলে আগাছা হিসেবে জন্মে। আমাদের দেশে সর্বত্র থাকার কথা বলা হলেও খুব একটা দেখা যায় না।

ভারতের কোনো কোনো অঞ্চলে এ গাছের মাংসল, শ্লেষ্মাযুক্ত পাতা এবং ডালপালা সবজি হিসেবে খাওয়া হয়। পাতার নির্যাস বিভিন্ন প্রয়োজনে ব্যবহার্য।