চোখজুড়ানো কৃষ্ণচূড়া রাধাচূড়া স্বর্ণচূড়া

চন্দ্রিমা লেকের পাশে ফোটা কৃষ্ণচূড়া ফুলছবি: লেখক

গ্রীষ্মের প্রখর তাপে যখন জীবনপাত হচ্ছে, তখনই প্রকৃতিতে চলছে অদ্ভুত এক সৌন্দর্যের প্রপাত। ঢাকা নগরীর পথে পথে, উদ্যানে উদ্যানে ভেসে চলেছে জলপ্রপাতের মতো তিন ধরনের পুষ্পস্রোত। চন্দ্রিমা লেকের পাশের রাস্তায় রক্তরাঙা কৃষ্ণচূড়া, জাতীয় সংসদ ভবনের পুব পাশে রোকেয়া সরণির পথপাশে সোনারঙা হলদে স্বর্ণচূড়া বা কনকচূড়া, কার্জন হলের সামনে হলদে-লাল রাধাচূড়া—গ্রীষ্মের এ তিন ফুল নগরীতে নিয়ে এসেছে কিছুটা প্রশান্তির বার্তা।

চলতে চলতে যদি গাড়ি কোথাও ট্রাফিক জ্যামে পড়ে যায়, তাহলে সেই ফাঁকে চোখ মেলে একটু তাকিয়ে দেখা যেতে পারে এসব ফুলকে, তাতে বিরক্তি কিছুটা হয়তো লাঘব হবে। সম্প্রতি ঢাকা শহরে এ তিন ফুলের গাছের মধ্যে কনকচূড়ার সম্প্রসারণটা মনে হয় ঘটেছে বেশি, এরপর হয়েছে কৃষ্ণচূড়ার। রাধাচূড়ার কিছু গাছ লাগানো হয়েছে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউর সড়ক বিভাজকে।

কার্জন হলের সামনে ফোটা কনকচূড়া ফুল
ছবি: লেখক

এই তিন গাছের নাম নিয়ে অনেকেরই মাঝেমধ্যে গোলমাল বাধে। মাদাগাস্কারের গাছ কৃষ্ণচূড়া কী করে আমাদের দেশে বাংলা নাম পেল কৃষ্ণচূড়া, তার ইতিহাস কোথাও পাইনি। কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত কৃষ্ণচূড়াকে তাঁর কবিতায় মর্যাদাবান করেছেন, রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলও বাদ পড়েননি। হিন্দিতে কৃষ্ণচূড়া ও রাধাচূড়া উভয়েরই নাম উল্লেখ করা হয়েছে গুলমোহর বা গুলমোর। অবশেষে গুলমোহর নামটি ভারতে গৃহীত হয়েছে কৃষ্ণচূড়ার নামে। স্বর্ণচূড়া নামটি ব্যবহার করেছেন গাছপালা তরুলতা বইয়ে নিসর্গী বিপ্রদাশ বড়ুয়া, আরেক নিসর্গী দ্বিজেন শর্মা দৈনিক অবজারভার পত্রিকায় এর নাম প্রস্তাব করেছিলেন কনকচূড়া। ধীরে ধীরে কনকচূড়া নামটি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে এবং বাংলা নাম হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। রাধাচূড়াকে কেউ কেউ বলেন ছোট কৃষ্ণচূড়া। কিন্তু কৃষ্ণচূড়া ও রাধাচূড়া সম্পূর্ণ আলাদা দুটি গাছ। কৃষ্ণচূড়া বৃক্ষ প্রকৃতির বৃহদাকার গাছ, রাধাচূড়া ছোট আকারের গুল্ম প্রকৃতির গাছ। দুটি গাছেরই ডালপালা নরম, ঝড়-বাতাসে পট পট করে ভেঙে যায়। কালবৈশাখীতে রাধাচূড়ার চেয়ে কৃষ্ণচূড়ার ডাল ভাঙে বেশি। অন্যদিকে স্বর্ণচূড়া কৃষ্ণচূড়ার চেয়ে লম্বা ও শক্তপোক্ত গাছ, ঝড়–বাতাসে ছোট ছোট ডালপালা ভাঙলেও বড় ডালের ক্ষতি হয় না, কৃষ্ণচূড়ার মতো আস্ত গাছটাই উপড়ে পড়ে না।

জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানে ফোটা রাধাচূড়া ফুল
ছবি: লেখক

তিনটি গাছই একই ফ্যাবেসি পরিবারের, শিমগোত্রীয় বলে এদের ফলের আকৃতিও শিমের মতো। কৃষ্ণচূড়ার উদ্ভিদতাত্ত্বিক নাম Delonix regia, কনকচূড়ার Peltophorum pterocarpum ও রাধাচূড়ার Poinciana pulcherrima। তিনটি গাছের পাতার গড়ন প্রায় একই, শুধু পত্রকগুলোর আকার-আকৃতি ভিন্ন, তিন প্রজাতির গাছের পাতাই পক্ষল যৌগিক, একটি পত্রদণ্ডের দুই ধারে সারিবদ্ধভাবে পত্রকগুলো সাজানো থাকে। তিনটি গাছের বৃদ্ধি, স্বভাব ও গাছের চেহারা দেখে যেমন এদের সহজে চেনা যায়, তেমনি আলাদা করা যায় ফুল দিয়ে। রাজরাজসিক চেহারার কৃষ্ণচূড়ার লাল টকটকে ফুল ফোটে থোকা ধরে, রানির মাথার মুকুটের মতো ডালের মাথায় মাথায় সোনারঙের উজ্জ্বল হলুদ ফুল ফোটে কনকচূড়ার আর রাধাচূড়া যেন দীনভিখারি। ওদের ফুল ফোটে ডালের আগায় চূড়ার মতো পুষ্পমঞ্জরিতে, কখনো সেসব ফুলের রং হয় জাতভেদে হলদে-লালে মেশানো, কখনোবা নিরেট হলুদ। বাতাসের দুলুনিতে সে তবু পথিককে আকৃষ্ট করার চেষ্টা করে।

তবে তিনটির মধ্যে সব দিক দিয়ে নগরতরু হিসেবে আমি এগিয়ে রাখব কনকচূড়াকে। কেননা এ ফুলের প্রস্ফুরণের প্রাচুর্যে ও সুগন্ধে বিমোহিত হয় মানব-পতঙ্গ সবাই, গাছও মজবুত, দীর্ঘজীবী, দারুমূল্যও আছে। ঢাকা ও অন্যান্য শহরের শোভা বাড়াতে অন্তত একটি সড়কের দুই পাশে এই ছায়াঘন কনকচূড়া লাগানো যায়।

  • মৃত্যুঞ্জয় রায়, কৃষিবিদ ও প্রকৃতিবিষয়ক লেখক