চুনতি বনের অবশিষ্ট উদ্ভিদগুলো 

চুনতি বনের বুনো টগর
ছবি: লেখক

শুধু নামেই চুনতি বন্য প্রাণী অভয়ারণ্য। এই অভয়ারণ্যে হাতি তো দূরের কথা, একটি শিয়ালও নির্বিঘ্নে ঘুরে বেড়াতে পারবে না। এমনকি প্রাণীর পালিয়ে থাকার মতো কোনো উদ্ভিদ-ঘনত্বও এই বনে নেই। 

অবস্থা এমনই, সেখানে নেই বন্য প্রাণী, নেই বনও। সম্প্রতি এই অভয়ারণ্যে গিয়ে এমন দৃশ্যই চোখে পড়েছে। প্রায় আট হাজার হেক্টর আয়তনের এই বনে এখন ছয় হাজার হেক্টরও অবশিষ্ট আছে কিনা সন্দেহ। বনের অধিকাংশ গাছ ১০ থেকে ১৫ বছর বয়সী। পুরোনো গাছের সংখ্যা একেবারেই নগণ্য। সবচেয়ে ভয়ংকর বিষয়, বনজুড়ে অ্যাকাশিয়ার বিস্তার। বনের নিজস্ব উদ্ভিদপ্রজাতি ধ্বংস করে সেখানে বিদেশি গাছ রোপণ বনের জন্য কোনো শুভ সংবাদ নয়। অ্যাকাশিয়া না লাগিয়ে বনের নিজস্ব প্রজাতির গাছ রোপণ করাটাই ছিল যুক্তিযুক্ত। বিকল্পও ছিল, বিরক্ত না করলে আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারত বনটি।

চুনতি বন্য প্রাণী অভয়ারণ্য ক্রান্তীয় মিশ্র চিরসবুজ বনের অংশ। চট্টগ্রাম শহর থেকে প্রায় ৭০ কিলোমিটার দক্ষিণে চট্টগ্রাম–কক্সবাজার মহাসড়কের পশ্চিম পাশে লোহাগাড়া উপজেলার বিস্তীর্ণ এলাকা নিয়ে চুনতির অবস্থান। অভয়ারণ্যটি চট্টগ্রামের বাঁশখালী, লোহাগাড়া এবং কক্সবাজার জেলার চকরিয়া উপজেলার চুনতি, অধুনগর, হারবং, পুঁইছড়ি, বড়হাতিয়া ও টইটং এলাকা নিয়ে গঠিত। ১৯৭৪ সালের বন্য প্রাণী সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী ১৯৮৬ সালে এই অভয়ারণ্য প্রতিষ্ঠা করা হয়।

চুনতি বনে একসময় প্রাকৃতিকভাবে জন্মানো গাছপালার মধ্যে বাইট্টা গর্জন, তেলিয়া গর্জন, ধুলিয়া গর্জন, চাপালিশ, বাঁশ, বেত, ট্রি-ফার্ন, অর্কিড ও বনকলা অন্যতম ছিল। মূলত এসব গাছের সন্ধানেই এ বনে বেড়াতে যাওয়া। বনে ঘুরে শুধু বিক্ষিপ্তভাবে কিছু গর্জন, পাঁচ থেকে সাত বছর বয়সী কিছু বেত, হাতে গোনা কয়েকটি চাপালিশ, দু–একটি ছোট হরিণা ও আওয়াল বা বাদ্রুকের দেখা পেয়েছি। ছোট গাছের মধ্যে কাউ, কালো জাম, দাঁতরাঙা, টগর, পিচণ্ডি এখনো যৎসামান্য টিকে আছে। বিস্তীর্ণ এলাকা ঘুরে বনকলা বা ফার্ন গাছের দেখা পাইনি। পুরোনো গাছ খুব একটা না থাকায় অর্কিডও প্রায় বিলুপ্ত। বনতলের লতাগুল্ম খুব একটা নেই বললেই চলে। অনেক আগেই চোরা শিকারি ও স্থানীয় মানুষ এসব সাফসুতরো করে ফেলেছে। এই বনে প্রাকৃতিকভাবে জন্মানো সেই সব পুরোনো গর্জন, চাপালিশ, বাঁশ ও বেতের ঝোপগুলো গেল কোথায়?

চুনতি বনের আওয়াল বা বাদ্রুক
ছবি: লেখক

আওয়াল বা বাদ্রুক; বৈজ্ঞানিক নাম Vitex pinnata এই বনের প্রায় বিলুপ্তির পথে এগিয়ে থাকা একটি বৃক্ষপ্রজাতি। সাধারণত ১০ থেকে ২০ মিটার পর্যন্ত উঁচু হতে পারে। পাতা ৩-পত্রক, মাঝেমধে৵ একটি বা দুটি ছোট পাতা যুক্ত থাকে। পত্রক সাধারণত ৭ থেকে ২০ সেন্টিমিটার, ডিম্বাকার বা উপবৃত্তাকার। পত্রবৃন্ত  দুই খাঁজযুক্ত, ৩ থেকে ৭ সেন্টিমিটার লম্বা; ৪ থেকে ৭ সেন্টিমিটার, রোমশ, মঞ্জরিপত্র স্থায়ী, ১০ থেকে ১৫ মিলিমিটার দীর্ঘ। বৃতিনল সাড়ে ৪ থেকে সাড়ে ৫ মিলিমিটার লম্বা, বাইরে ঘন ক্ষুদ্র রোমাবৃত। দলমণ্ডল নীলচে রঙের ঠোঁটযুক্ত সাদাটে, নল প্রায় ৮ মিলিমিটার লম্বা। ফল ৬ থেকে ৮ মিলিমিটার লম্বা, প্রসারিত পেয়ালা আকৃতির বৃতির মাধ্যমে আবৃত। ফুল ও ফলের মৌসুম জুলাই থেকে অক্টোবর মাস পর্যন্ত বিস্তৃত।

এই গাছ সাধারণত চিরহরিৎ মিশ্র বনাঞ্চলে প্রাকৃতিকভাবে জন্মে। কাঠ লালাভ বা জলপাই-বাদামি রঙের, শক্ত ভিত্তির সঙ্গে যুক্ত অবস্থায় খুবই টেকসই। লাঙল এবং অন্যান্য কৃষি যন্ত্রপাতি তৈরিতে ব্যাপকভাবে ব্যবহার্য।

বনের ভেতর নিজের শক্তিতে টিকে থাকা আরেকটি উদ্ভিদ বুনো টগর; বৈজ্ঞানিক নাম Tabernaemontana divaricata। বনতলে বেশ কিছু বুনো টগর চোখে পড়ল। টগর ছাড়াও গাছটি কাঠমল্লিকা এবং কুটিল নামে পরিচিত। আমাদের চারপাশে টগরের বিভিন্ন রকমফের দেখা গেলেও বুনো টগর প্রধানত বনাঞ্চলেই দেখা যায়। পর্যায়ক্রমে সারা বছর সাদাটে রঙের দু–একটি করে ফুল ফুটতে থাকে। অনেক বৈরী পরিস্থিতিতে টিকে থাকতে পারা গাছটির অন্যতম বৈশিষ্ট্য। নগর উদ্যানে দীর্ঘকালীন পুষ্পপ্রাচুর্যের জন্য এ ফুল নির্বাচন করা যেতে পারে। ডালগুলো বহু শাখা-প্রশাখা নিয়েও বাগানের শোভা বাড়ায়। এ গাছের পাতা, ফুল, মূল, মূলের ছাল ও কষ নানান রোগের ওষুধ হিসেবে কাজে লাগে।

স্থানীয় একাধিক সূত্রমতে, বনের অভ্যন্তরে এবং পাশ্ববর্তী এলাকায় বেশ কিছু করাতকল আছে। তা ছাড়া অভয়ারণ্যের আশপাশে ৮ থেকে ১০টির মতো ইটভাটা চিহ্নিত করা হয়েছে। আবার বনকে ঘিরে গড়ে উঠেছে আসবাবের অসংখ্য দোকান। এই চিত্র থেকে খুব সহজেই অনুমেয়, চুনতি অভয়ারণ্যের ভাগ্যে কী ঘটেছিল।