হলদেপেট টুনির সন্ধানে
পাখিটিকে খুঁজছি বেশ কয় বছর ধরে। ওর খোঁজে ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে আমার সাবেক গবেষণা সহকারী ও ছাত্র, পক্ষীচিকিৎসক ডা. সাদ্দাম হোসেনকে সঙ্গে নিয়ে চট্টগ্রামের এভারকেয়ার হাসপাতালের সামনে অবস্থিত অনন্যা আবাসিক প্রকল্পে গেলাম। ওখানটায় বেশ ঝোপঝাড় ও হোগলা বন রয়েছে। চমৎকার পরিবেশ। কিন্তু সঠিক সময়ে সঠিক জায়গায় গিয়ে প্রচুর পাখির দেখা পেলেও হলদেপেটের ছোট্ট পাখিটির দেখা পেলাম না।
পরের বছর জানুয়ারিতে আবারও গেলাম চট্টগ্রামে। এবার চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি অ্যান্ড অ্যানিমেল সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়ের (সিভাসু) আমন্ত্রণে চতুর্থ বর্ষ প্রাণিচিকিৎসার ছাত্রছাত্রীদের বন্য প্রাণী চিকিৎসা বিষয়ে পরীক্ষা নিতে গেলাম। ছয় দিন পরীক্ষা, তবে শুধু বিকেলে। সকালটা ফ্রি। প্রথম তিন দিন সকালে বেশ কুয়াশা পড়ল। কাজেই অনন্যায় যাওয়া হলো না। এরপর এল শুক্রবার। সেদিন কুয়াশা নেই। কাজেই সাদ্দামকে নিয়ে সিভাসুর অধ্যাপক ড. জুনায়েদ সিদ্দিকীর গাড়িতে করে অনন্যায় গেলাম। খোঁজখবর নিয়ে জেনেছিলাম এটিকে শুধু হোগলা বনের ভেতর পাওয়া যায়। কিন্তু হোগলা বনে তন্ন তন্ন করে খুঁজেও পাখিটির সন্ধান পেলাম না।
হোগলা বনের পাশ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ দেখা হয়ে গেল, চট্টগ্রামের পক্ষী আলোকচিত্রী ও ব্যাংকার আহসানউদ্দিন চৌধুরী ও কুমিল্লা বার্ড ক্লাবের দুজন সদস্যের সঙ্গে। হলদেপেটের পাখিটির খোঁজে এসেছি শুনে আহসানউদ্দিন বলল, ‘বহুদিন পর আমরা এখানে এসেছি স্যার। ওকে আমরাও খুঁজছি। কল দিয়ে দেখি কী হয়?’ বলেই সামনের দিকে হাঁটা দিল। আমরাও ওকে অনুসরণ করলাম। প্রায় ১০০ কদম এগিয়ে মুঠোফোন বের করে পাখিটির রেকর্ড করা ডাক বাজাল আহসানউদ্দিন। ক্যামেরার ভিউ ফাইন্ডারে চোখ রেখে অপেক্ষায় রইলাম। দু-তিনবার ডাক বাজানোর পর হোগলা বনে পাখিটির লাফালাফি শুরু হয়ে গেল। মাত্র কয়েক সেকেন্ডের জন্য পাখিটি বের হয়ে এল, এরপর উধাও। দুটি ক্লিক করলাম, ছবি ভালো হলো না। দুই মিনিট পর আবারও ডাক বাজাল। রাস্তার দুই ধারে হোগলা বন। এক পাশের বন থেকে পাখিটি বেরিয়ে অন্য পাশের বনে ঢুকল। প্রস্তুতি নিয়ে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রইলাম। দুরন্ত পাখিটির অস্থিরতা কিছুটা কমল। এবার সে হোগলাগাছের শীর্ষের মরা পাতার ওপর বসল। আমিও সমানে শাটার চেপে গেলাম। ভালো ছবি পেয়ে যাওয়ার পর যেন পাখিটির আনাগোনা বেড়ে গেল। এবার আর ডাক ছাড়তে হলো না। দু-তিনটি পাখির আগমন ঘটল এবং তারা আশপাশের দু-তিনটি প্লটের ঝোপঝাড় ও হোগলা বনে লাফালাফি করতে শুরু করল। মনে তৃপ্তি নিয়ে আরেকটি দুর্লভ পাখির খোঁজে আগের হোগলা বনে ফেরত গেলাম।
এ দেশের দুর্লভ আবাসিক পাখি হলদেপেট টুনি। কেউ কেউ বলেন হলদেপেট লেজতোলা টুনি। পশ্চিমবঙ্গে বলে হলদেপেট ফুটকি। ইংরেজি নাম ইয়েলোবেলিড প্রিনিয়া। চিস্টিকোলিডি গোত্রের পাখিটির বৈজ্ঞানিক নাম Prinia flaviventris। বাংলাদেশসহ দক্ষিণ, পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অনেক দেশেই দেখা যায়।
প্রাপ্তবয়স্ক হলদেপেট টুনির দেহের দৈর্ঘ্য ১৩ সেন্টিমিটার এবং ওজন মাত্র ৭ গ্রাম। একনজরে দেহের ওপরটা, পিঠ থেকে লেজের গোড়া পর্যন্ত, কালচে-জলপাই বাদামি। ঘাড়-মাথা-কান ঢাকনি কালচে ধূসর। চোখের চারদিক ও সরু ভ্রু-রেখাটি সাদা। চোখের মণি ও ঠোঁট হলদে-বাদামি। পা, পায়ের পাতা ও আঙুল কমলা-ধূসর। স্ত্রী ও পুরুষ পাখি দেখতে একই রকম। অপ্রাপ্তবয়স্ক পাখির ডানার লালচে-বাদামি প্রান্তসহ পিঠ হলদে জলপাই-বাদামি ও দেহতল অনুজ্জ্বল হলদে।
প্রজাতিটিকে সিলেট, চট্টগ্রাম ও খুলনা বিভাগের পাহাড়ের পাদদেশ ও সমতলভূমিতে অবস্থিত তৃণভূমি ও ক্ষুদ্র ঝোপঝাড়ে দেখা যায়। সচরাচর একাকী বিচরণ করে; তবে কখনো কখনো তিন থেকে চারটির ছোট বিচ্ছিন্ন দলেও দেখা যেতে পারে। মাটির কাছাকাছি ঝোপঝাড়ে কিংবা ঘাসের মধ্যে কীটপতঙ্গ ও তাদের শূককীট খুঁজে খায়। অত্যন্ত চঞ্চল পাখিটি এদিক-সেদিক ঘুরে বেড়াতে পছন্দ করে। প্রজননকালে পুরুষ পাখি ‘টিউয়ি, টিউয়ি—ডুলু-লু-লি, ডিজিইইই, চিঙ্ক-চিঙ্ক’ স্বরে ডাকে।
এপ্রিল থেকে অক্টোবর প্রজননকাল। এ সময় ভূমিতে ঘাসের মধ্যে অথবা ঝুলন্ত পাতায় মাকড়সার জালে ঘাস ও শিকড় আটকে বাটির মতো ডিম্বাকার বাসা বানায়। স্ত্রী ডিম পাড়ে ৩ থেকে ৫টি। ডিমের রং লাল। ডিম ফোটে ১১ থেকে ১৪ দিনে। ছানাদের প্রধান খাবার কীটপতঙ্গ। ছানারা ১১ থেকে ১২ দিনে উড়তে শেখে। স্ত্রী-পুরুষ মিলেমিশে ডিমে তা দেয় এবং ছানাদের খাওয়ায় ও যত্নœকরে। আয়ুষ্কাল ৫ থেকে ৬ বছর।
আ ন ম আমিনুর রহমান, পাখি ও বন্য প্রাণী প্রজনন ও চিকিৎসাবিশেষজ্ঞ, গাজীপুর কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়