এপ্রিলে যে ২৪ এলাকায় তাপমাত্রা রেকর্ড বেড়েছে
আবহাওয়া অধিদপ্তরের উপাত্ত বিশ্লেষণে দেখা যায়, কম তাপের এলাকা ও উপকূলীয় অঞ্চলে তাপমাত্রা বেড়ে গেছে।
দেশের সবচেয়ে উত্তরের জনপদ পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া ‘শীতের হটস্পট’ হিসেবে পরিচিত। হিমালয় পর্বতমালা সেখান থেকে কাছে। ফলে শীতের মৌসুমে শীত বেশি। গ্রীষ্মকালে দেশের অন্য অঞ্চলের মতো প্রচণ্ড গরম পড়ে না। কিন্তু সদ্য শেষ হওয়া এপ্রিল মাসে তেঁতুলিয়া উপজেলা ও পঞ্চগড় জেলায় যে গরম পড়েছে, তা ওই এলাকার মানুষের কাছে একেবারে নতুন অভিজ্ঞতা।
জেলা শহরটির নতুন বস্তি-বানিয়াপট্টি এলাকায় থাকেন বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল আউয়াল (৭৬)। তিনি গতকাল বুধবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘জীবনে মনে হয় এবারই প্রথম এত তাপপ্রবাহ দেখছি।’
শুধু তেঁতুলিয়া নয়, দেশের ৫০ শতাংশের বেশি এলাকায় এ বছরের এপ্রিলের তাপমাত্রা সবচেয়ে বেশি ছিল (হিসাব শুরুর পর)। আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, সার্বিকভাবে দেশে এবারের এপ্রিল মাসে গড় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৬ দশমিক ২ ডিগ্রিতে।
এ বছর এপ্রিল মাসের প্রথম দিন থেকে দেশের বিভিন্ন এলাকায় তাপপ্রবাহ শুরু হয়। এপ্রিলজুড়েই এই তাপপ্রবাহ ছিল। আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছিল, দেশে গত ৭৬ বছরে এত বিস্তৃত এলাকাজুড়ে এবং এই মাত্রায় তাপপ্রবাহ হয়নি।
বৃষ্টিও কম হয়েছে। এপ্রিল মাসে গড়ে বৃষ্টি হয় ১৩০ দশমিক ২ মিলিমিটার। এবারের এপ্রিলে তার চেয়ে ৮১ শতাংশ বৃষ্টি কম হয়েছে। রংপুর ও রাজশাহী বিভাগ একেবারেই বৃষ্টিহীন ছিল। রাজধানীতে বৃষ্টি কম হয়েছে ৯১ শতাংশ।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের তাপমাত্রার উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দুটি প্রবণতা দেখা যায়। একটি হলো, দেশের আপাত কম তাপমাত্রার অঞ্চল হিসেবে পরিচিত এলাকাগুলোয় বেড়ে গেছে তাপ। অন্যটি হলো, উপকূলের প্রায় সব এলাকায় তাপ বেড়েছে।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ মো. ওমর ফারুক প্রথম আলোকে বলেন, ‘দেশের ৫০ শতাংশেরও বেশি স্থানে একযোগে তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার এমন ঘটনা আগে কখনো ঘটেছে বলে মনে হয় না।’
নির্দিষ্ট একটি মাসের হিসাব দিয়ে আবহাওয়া বা জলবায়ু পরিস্থিতির মূল্যায়ন করা যায় না। কিন্তু জলবায়ু ও আবহাওয়া বিশেষজ্ঞ এবং পরিবেশবাদীরা তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার এই প্রবণতা এবং অতি কম বৃষ্টিকে আশঙ্কাজনক বলে মনে করছেন। দীর্ঘ মেয়াদে এর নেতিবাচক প্রভাব আছে, এমন মত তাঁদের।
দেশের ৫০ শতাংশেরও বেশি স্থানে একযোগে তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার এমন ঘটনা আগে কখনো ঘটেছে বলে মনে হয় না।মো. ওমর ফারুক, আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ
কোন এলাকায় কতটা তাপমাত্রা বাড়ল
আবহাওয়া অধিদপ্তর এখন দেশের ৪৪টি স্টেশন থেকে প্রতিদিন আবহাওয়ার উপাত্ত সংগ্রহ করে। এসব স্টেশনের মধ্যে কিছু আছে যেগুলোর মাধ্যমে ১৯৪৮ সাল থেকে আবহাওয়ার উপাত্ত সংগ্রহ করা হচ্ছে। কিছু স্টেশন আবার নতুন হয়েছে। সর্বশেষ ২০১৭ সালেও চারটি স্টেশন হয়।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ৪৪টি স্টেশনের মধ্যে চলতি বছর এপ্রিল মাসে ২৪টি স্টেশনের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা আগের যেকোনো সময়ের (হিসাব শুরুর পর) চেয়ে বেড়ে গেছে। এর মধ্যে তেঁতুলিয়া, কুড়িগ্রামের রাজারহাট, নওগাঁর বদলগাছি, কুষ্টিয়া ও গোপালগঞ্জে তাপমাত্রা প্রায় ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস করে বেড়েছে।
উপাত্ত বিশ্লেষণে দেখা যায়, ১৯টি স্টেশনের সর্বোচ্চ গড় তাপমাত্রা বিগত এক দশকে বাড়তির দিকে ছিল। আটটিতে বাড়তির দিকে ছিল তিন বছর। এবার এসে আগের রেকর্ড অতিক্রম করে যায়। বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ মো. ওমর ফারুক বলেন, দেখা যাচ্ছে, গত ৩ থেকে ১০ বছরের মধ্যে এপ্রিল মাসের গড় তাপমাত্রার এ বৃদ্ধি ঘটেছে।
এ বছর এপ্রিল মাসের প্রথম দিন থেকে দেশের বিভিন্ন এলাকায় তাপপ্রবাহ শুরু হয়। এপ্রিলজুড়েই এই তাপপ্রবাহ ছিল। আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছিল, দেশে গত ৭৬ বছরে এত বিস্তৃত এলাকাজুড়ে এবং এই মাত্রায় তাপপ্রবাহ হয়নি।
এবার এপ্রিল মাসজুড়ে বৃষ্টির জন্য হাপিত্যেশ করেছেন দেশের মানুষ। কিন্তু আকাশ কালো হয়ে বৃষ্টি ঝরেনি। বরং কম বৃষ্টির রেকর্ড হয়েছে।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের হিসাবে, দেশের যে পাঁচটি স্টেশনে এপ্রিল মাসে তাপমাত্রা আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে প্রায় ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়েছে, তার মধ্যে তিনটিই কম তাপের এলাকা হিসেবে পরিচিতি। এর মধ্যে আছে উত্তরের তিন জনপদ তেঁতুলিয়া, নওগাঁর বদলগাছি এবং রাজারহাট।
অপরদিকে যে ২৪টি স্টেশনে এবারের এপ্রিলে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা বেড়েছে, এর মধ্যে ১২টিই উপকূলীয় এলাকা। দেশের দক্ষিণের জনপদ বরিশাল বিভাগের চারটি স্টেশন থেকে আবহাওয়া অধিদপ্তর তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে। স্টেশনগুলো হলো বরিশাল, পটুয়াখালী, খেপুপাড়া ও ভোলা। দেখা গেছে, চারটি স্টেশনেই এবারের এপ্রিলে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি।
দক্ষিণের খুলনা বিভাগের ছয় স্টেশনের মধ্যে তিনটিতেই তাপমাত্রা বেড়েছে। সেগুলো হলো খুলনা, মোংলা ও কুষ্টিয়ার কুমারখালী। এর মধ্যে খুলনা ও মোংলা উপকূলীয় এলাকার মধ্যে পড়েছে।
দেশের যেসব এলাকায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা সব সময় অন্য এলাকার চেয়ে কম থাকে তার মধ্যে আছে চট্টগ্রাম। এ বিভাগে ১৩টি স্টেশন আছে আবহাওয়া অধিদপ্তরের। তার মধ্যে ছয়টিতেই এবারের এপ্রিলে তাপমাত্রা অতীতের রেকর্ড ছাড়িয়েছে। তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়া এলাকাগুলো হলো সীতাকুণ্ড, পতেঙ্গা, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, কুতুবদিয়া ও টেকনাফ।
দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়া ও সুপেয় পানির সংকট আগে থেকেই আছে। এর মধ্যে তাপমাত্রা বৃদ্ধি নতুন বিপদের ইঙ্গিত দিচ্ছে বলে মনে করে জলবায়ু বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পানি ও বন্যা ব্যবস্থাপনা ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক এ কে এম সাইফুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘গবেষণায় দেখেছি, দেশের উপকূলীয় এলাকায় উষ্ণতা বাড়ছে। আবহাওয়া অধিদপ্তরের এপ্রিল মাসের তাপমাত্রার মূল্যায়নে সেই বাস্তবতার প্রতিফলন ঘটেছে।’
আবহাওয়া অধিদপ্তর বলছে, এবার এপ্রিলে বৃষ্টি হয়েছে ২৫ মিলিমিটারের মতো।
কম বৃষ্টির রেকর্ড এপ্রিলে
এবার এপ্রিল মাসজুড়ে বৃষ্টির জন্য হাপিত্যেশ করেছেন দেশের মানুষ। কিন্তু আকাশ কালো হয়ে বৃষ্টি ঝরেনি। বরং কম বৃষ্টির রেকর্ড হয়েছে। আবহাওয়া অধিদপ্তর বলছে, এপ্রিলে বৃষ্টি হয়েছে ২৫ মিলিমিটারের মতো।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ মুহাম্মদ আবুল কালাম মল্লিক তাপপ্রবাহ, বজ্রঝড় ও বৃষ্টিপাত নিয়ে গবেষণা করেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘এবার এপ্রিল মাসে যে বৃষ্টি হয়েছে, তা অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে কম।’
আবুল কালাম মল্লিক ১৯৮১ থেকে চলতি বছরের এপ্রিল মাসে ঝড়ের বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন, এবার এপ্রিল মাসে শুধু একটি বর্জ্যঝড় হয়েছে, যা ৪৩ বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম। গত বছর এপ্রিলে বর্জ্যঝড় হয়েছিল সাতটি।
অবশ্য শুধু বাংলাদেশ নয়, পুরো উপমহাদেশের বড় অংশজুড়ে এবার তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। এর পেছনে প্রশান্ত মহাসাগরীয় জলবায়ু পরিস্থিতি ‘এল নিনো’র সক্রিয়তাকেই কারণ হিসেবে উল্লেখ করেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁদের মতে, এল নিনো গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে সক্রিয় হতে শুরু করে। গত মাস এপ্রিলের মাঝামাঝি তা নিষ্ক্রিয় হতে থাকে। এল নিনো বিদায় নিলেও এর রেশ রয়ে গেছে বলে মনে করেন বুয়েটের অধ্যাপক এ কে এম সাইফুল ইসলাম। তিনি বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে বড় দিক হচ্ছে অনিশ্চিত আবহাওয়া। এটি কখন কীভাবে আচরণ করবে, তা বোঝা মুশকিল। তিনি বলেন, এবার উষ্ণতা বেশি থাকলেও আগামী বছর হয়তো তা হবে না। কিন্তু তাপমাত্রা বৃদ্ধির এই প্রবণতা কমার লক্ষণ নেই। বৈশ্বিকভাবেই তাপমাত্রা বাড়ছে। এর প্রভাব স্বাভাবিকভাবেই মানুষের ওপর পড়ছে।