বাংলাদেশের যত চড়ুই

ভুটানের রাজধানী থিম্পুর ওয়াংচু নদীর তীরের ঝোপে দারুচিনি চড়ুই
ছবি: লেখক

ক্যামেরা হাতে ভুটানের রাজধানী থিম্পুর ওয়াংচু নদীর পাড়ে হাঁটছি। বিভিন্ন প্রজাতির পাখির মেলায় কালো-টুপি লালগির্দি নামে সুন্দর এক পাখির দেখা পেলাম। এর ছবি তোলার সময় পাশের ঝোপে ছোট ছোট পাখি দেখে চুপি চুপি সেদিকে গেলাম। ঝোপে চড়ুইয়ের মতো দেখতে এক জোড়া পাখি পাশাপাশি বসে ছিল। একটু ভালোভাবে লক্ষ করতেই ওদের চিনতে পারলাম। ঘটনাটি ১৬ অক্টোবর ২০১৮-এর।

এর প্রায় এক বছর আগে বাংলাদেশের তেঁতুলিয়ার ডাকবাংলো থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘার ছবি তুলে ১০ কিলোমিটার দূরের শালবাহান ইউনিয়নের তুলসিয়া বিলের দিকে যাচ্ছিলাম। কিছু দূর যাওয়ার পর সরু খালের মতো গোবরা নদী যেখানে রাস্তা স্পর্শ করেছে, সেখানকার মনোরম দৃশ্য দেখে ভ্যান থেকে নামলাম।

চমৎকার আবহাওয়া, তবে রোদের তেজ একটু বেশি। নদীর আশপাশটা ঘুরে একসময় উল্টো দিকের আখখেতের দিকে চোখ পড়তেই এক ঝাঁক চড়ুইকে আখ ফুলের বিচি খেতে দেখলাম। কিন্তু তির্যকভাবে রোদ পড়ায় ও পাখিগুলো সূর্যের দিকে থাকায় পালকের রং ভালোভাবে বোঝা গেল না।

ঢাকার জিগাতলায় একটি পুরুষ ঘরচড়ুই
ছবি: লেখক

দ্রুত তুলসিয়া বিলের দিকে চলে যাওয়ায় গোবরা নদীর পারের পাখিগুলো নিয়ে চিন্তা করার কথা ভুলেই গেলাম। এমনকি পরের বছর ভুটানের চড়ুইগুলোর ছবি তোলার পরও তেঁতুলিয়ারগুলোর সঙ্গে মিলিয়ে দেখার চিন্তা মাথায় এল না।

হয়তো এ দেশের পক্ষীতালিকায় চড়ুইটির নাম না থাকায় বিষয়টি চিন্তায় আসেনি। যাই হোক, এরও প্রায় তিন বছর পর একটি পাখি শনাক্ত করতে গিয়ে তেঁতুলিয়ার ফোল্ডারটি খুলতেই চড়ুইগুলো চোখে পড়ল। এরপর ঘণ্টা দুয়েক নানা পরীক্ষা, উত্তেজনা ও পক্ষীবিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনার পর দেশের পক্ষীতালিকায় নতুন একটি পাখি যোগ করতে পেরে মনটা আনন্দে ভরে উঠল। প্রমাণিত হলো তেঁতুলিয়া ও ভুটানে তোলা চড়ুইগুলো ছিল একই প্রজাতির। সেই সঙ্গে দেশের চড়ুইয়ের প্রজাতি দুটি থেকে বেড়ে হলো তিনটি।

তেঁতুলিয়ার আখখেতে ও ভুটানের ওয়াংচু নদীর তীরে দেখা চড়ুইটির নাম রাসেট/সিনামন বা সিনামন ট্রি স্প্যারো। এর কোনো বাংলা নাম নেই। তবে পালকের রং, ইংরেজি ও বৈজ্ঞানিক নামের অর্থ বিবেচনায় দারুচিনি বা মরচেরঙা চড়ুই বলা যায়। প্যাসারিডি গোত্রের চড়ুইটির বৈজ্ঞানিক নাম Passer cinnamomeus। রাশিয়া, আফগানিস্তান, পাকিস্তান, ভারত, নেপাল ও ভুটানের পাহাড়ি এলাকা হয়ে চীন, মিয়ানমার, লাওস, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, তাইওয়ান, উত্তর কোরিয়া ও জাপান পর্যন্ত ওদের বিস্তৃতি। পাহাড়ি বনের বাসিন্দা হলেও শহর-গ্রাম-বাগান, মুক্তাঞ্চল ও সমুদ্রের আশপাশেও দেখা যায়। ১৪ থেকে ১৫ সেন্টিমিটার দৈর্ঘ্যের চড়ুইটির ওজন ১৮ থেকে ২২.৫ গ্রাম।

এ ছাড়া যে দুই প্রজাতির চড়ুই এ দেশে বাস করে, তার প্রথমটি চিরচেনা ঘরচড়ুই বা চড়াই (হাউস স্পেরো)। বহুল দৃশ্যমান আবাসিক পাখিটির দৈর্ঘ্য ১৫ সেন্টিমিটার। ওজন ২৫ থেকে ২৮ গ্রাম। শহর-বন্দর-গ্রামসহ সব জায়গায়ই আছে। তবে মানুষের আবাস এলাকায় বেশি। অ্যান্টার্কটিকা বাদে বিশ্বের সবখানেই বাস করে।

তুলনামূলকভাবে বিরল দেশের দ্বিতীয় চড়ুইটির নাম গেছো চড়ুই (ইউরেশিয়ান ট্রি স্পেরো)। সিলেট বিভাগ, ঠাকুরগাঁও-পঞ্চগড় ও খাগড়াছড়ির পাখিটিকে সিলেটের টিলাগড়, পঞ্চগড় শহর ও খাগড়াছড়ির দীঘিনালায় দেখেছি। মূলত ইউরোপ, উত্তর আফ্রিকা এবং দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে দেখা যায়। তিন প্রজাতির মধ্যে আকারে ছোট চড়ুইটির দৈর্ঘ্য ১২.৫ থেকে ১৪ সেন্টিমিটার। ওজন প্রায় ২৪ গ্রাম।

ঘরচড়ুই ও দারুচিনি চড়ুইয়ের স্ত্রী-পুরুষে পার্থক্য থাকলেও গেছো চড়ুইয়ের স্ত্রী-পুরুষ একই রকম। পুরুষ ঘরচড়ুইয়ের মাথার চাঁদি ধূসর, ঘাড় ও চক্ষুডোরা তামাটে। দারুচিনি চড়ুইয়ের পুরুষের মাথা থেকে কোমর পর্যন্ত উজ্জ্বল লাল। চক্ষুডোরা কালচে-ধূসর। অন্যদিকে গেছো চড়ুইয়ের মাথা খয়েরি, কান-ঢাকনিতে কালো ফুটকি ও গলায় সাদা মালা।

খাগড়াছড়ির দীঘিনালায় একটি গেছো চড়ুই
ছবি: লেখক

ঘরচড়ুই ও দারুচিনি চড়ুইয়ের স্ত্রীর মধ্যে পার্থক্য থাকলেও উভয়ই হালকা হলদে-বাদামি; বুক ও পেট বাদামি-ধূসর। শস্যদানা ও বীজভুক পাখিগুলো বাদাম, ফল ও পোকামাকড়ও খেতে পারে।

প্রজাতিভেদে মার্চ থেকে আগস্টে প্রজনন করে। মানুষের ঘরবাড়ির ফোকর, ভেন্টিলেটর বা চালের নিচে বাসা বানায়। গেছো চড়ুই গাছের খোঁড়ল, দালানের ফোকর ও পাথরের ফাঁকে বাসা বানায়। কিন্তু দারুচিনি চড়ুই বাসা বানায় গাছের প্রাকৃতিক খোঁড়লে। কাঠঠোকরা ও চিলের পরিত্যক্ত বাসাও ব্যবহার করে। প্রজাতিভেদে ৩ থেকে ৮টি ডিম পাড়ে, যা ১০ থেকে ১৪ দিনে ফোটে। ছানারা ১৪ দিনে ২১ দিনে উড়তে শেখে। আয়ুষ্কাল প্রায় ৫ বছর।

  • আ ন ম আমিনুর রহমান, পাখি ও বন্য প্রাণী প্রজনন ও চিকিৎসাবিশেষজ্ঞ