সবার জন্য নিরাপদ পানি নিশ্চিতে বাংলাদেশের লাগবে ৭৫ বছর, ভারত–পাকিস্তানের অবস্থা কী
দেশের ৪০ শতাংশের বেশি মানুষ নিরাপদ পানি পায় না। এসডিজি অনুযায়ী, ২০৩০ সালের মধ্যেই সবার জন্য নিরাপদ পানির ব্যবস্থা করতে হবে।
পানির সরবরাহ বৃদ্ধি, খোলা স্থানে মলত্যাগের অভ্যাস প্রায় শূন্যে নামিয়ে আনা, স্যানিটেশনের আওতা বাড়ানো—এমন নানা ক্ষেত্রে অগ্রগতি আছে বাংলাদেশের। তবে এত কিছুর পরও দেশের ৪০ শতাংশের বেশি মানুষ নিরাপদ পানি পায় না। এ ক্ষেত্রে গত প্রায় এক দশকে মাত্র ৩ শতাংশ অগ্রগতি হয়েছে। এভাবে চললে সবার জন্য নিরাপদ পানি নিশ্চিত করতে আরও ৭৫ বছর লাগতে পারে। আগামী ২৫ বছরের মধ্যে ভারত ও ভুটান সব মানুষের জন্য নিরাপদ পানি নিশ্চিত করতে পারবে। যদিও নিরাপদ পানি প্রাপ্তির এ হারের দিক থেকে বাংলাদেশের চেয়ে অনেক পিছিয়ে পাকিস্তান।
জাতিসংঘের দুই সংস্থা ইউনিসেফ ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) জয়েন্ট মনিটরিং প্রোগ্রাম (জেএমপি) ২০২৫–এর প্রতিবেদনে এ চিত্র উঠে এসেছে। চলতি মাসেই এ প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। পানি, স্যানিটেশন ও স্বাস্থ্যবিধি (ওয়াশ) খাতে জাতিসংঘের সদস্যরাষ্ট্রগুলোর অবস্থা তুলে ধরে দুই বছর পরপর এ প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।
২০০০ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত জাতিসংঘের তৈরি করা সহস্রাব্দের উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় (এমডিজি) সবার জন্য পানি নিশ্চিতের কথা ছিল। জেএমপির প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশের প্রায় ৯৯ শতাংশ মানুষ খাবার পানি পায়। ২০১৫ সালে এ হার ছিল ৯৭ শতাংশ। এখন জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অনুযায়ী, ২০৩০ সালের মধ্যেই সবার জন্য নিরাপদ পানির ব্যবস্থা করতে হবে।
জেএমপির এই প্রতিবেদন মূল্যায়ন করে অর্থনীতিবিদ হোসেন জিল্লুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘সবার জন্য পানি এবং সবার জন্য নিরাপদ পানি এক নয়। আমরা এমডিজিতে যে অর্জন করেছিলাম, সেটা নিয়ে আত্মতুষ্টিতে ভুগেছি এবং এখনো ভুগছি। এসডিজির লক্ষ্যমাত্রা অনেক চ্যালেঞ্জিং। কিন্তু নিরাপদ পানি পাওয়ার ক্ষেত্রে আমরা সক্ষমতা দেখাতে পারছি না।’
নিরাপদ পানি বলতে কী বোঝায়
নিরাপদ পানি বলতে বোঝায় এমন পানি, যার উৎস থেকে মানুষ সহজে পানি পেতে পারে। কারও নিজস্ব জমি বা বাড়ির ভেতরেই সেই উৎস থাকবে। এ পানি যখনই প্রয়োজন, তখনই পাওয়া যাবে এবং তা অবশ্যই মলের জীবাণু ও ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ থেকে মুক্ত। এটি এসডিজি ৬.১-এর একটি মূল ধারণা।
বাংলাদেশে নিরাপদ পানির কী অবস্থা
জেএমপির প্রতিবেদন অনুযায়ী, পানি অনিরাপদ করে ই–কোলাইয়ের মতো মলের জীবাণু। দেশের প্রায় ৬০ জেলায় আর্সেনিক দূষণ রয়েছে। এসব বিবেচনায় এখন ৫৯ শতাংশ মানুষ নিরাপদ খাবার পানি পায়। ২০১৫ সালে এ হার ছিল ৫৬ শতাংশ।
চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) ক্যাম্পাসের পানি পান করে বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী অসুস্থ হয়ে পড়েন। পানির এ অবস্থার কারণে অনেক শিক্ষার্থী হল ছেড়ে বাসায়ও চলে যান। শিক্ষার্থীরা তখন জানিয়েছিলেন, পানির সমস্যার কারণে তাঁদের একাডেমিক কার্যক্রমও বন্ধ থাকে দিন কয়েক। বুয়েটের উপাচার্য আবু বোরহান মোহাম্মদ বদরুজ্জামান পানির সমস্যার কথা তখন স্বীকার করেছিলেন।
বুয়েটের মতো এমন একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে খাওয়ার পানিতে এই দূষণ আলোচনার সৃষ্টি করে। তবে শুধু বুয়েটেই নয়, দেশের অনেক স্থানের সরবরাহের পানিতেও মলের জীবাণু রয়ে গেছে। ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, নারায়ণগঞ্জ ও খুলনায় এখন ওয়াসার সরবরাহের পানি আছে। কিন্তু সেই পানিও সুপেয় নয়। আর এসব কারণে বাংলাদেশে নিরাপদ পানি পাওয়ার হার কম।
জেএমপির প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘বাংলাদেশে নিরাপদ পানি প্রাপ্তির ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সীমাবদ্ধতা পানির গুণগত মান। বাংলাদেশের ৬৪ জেলার মধ্যে ৪৪ জেলায় অর্ধেকের কম মানুষ এমন উন্নত পানি ব্যবহার করছে, যা নিজস্ব বাড়ির ভেতরে পাওয়া যায়, প্রয়োজনমতো সব সময় পাওয়া যায় এবং দূষণমুক্ত।’
‘সবার জন্য পানি এবং সবার জন্য নিরাপদ পানি এক নয়। আমরা এমডিজিতে যে অর্জন করেছিলাম, সেটা নিয়ে আত্মতুষ্টিতে ভুগেছি এবং এখনো ভুগছি। এসডিজির লক্ষ্যমাত্রা অনেক চ্যালেঞ্জিং। কিন্তু নিরাপদ পানি পাওয়ার ক্ষেত্রে আমরা সক্ষমতা দেখাতে পারছি না।’হোসেন জিল্লুর রহমান অর্থনীতিবিদ
দক্ষিণ এশিয়ায় কার কী অবস্থা
এক দশকে নিরাপদ পানি প্রাপ্তির দিক থেকে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে এগিয়ে ভারত। দেশটিতে এখন ৭৬ শতাংশ মানুষ নিরাপদ পানি পায়। ২০১৫ সালে এ হার ছিল ৬১ শতাংশ। ভুটানের ৬৬ শতাংশ মানুষ নিরাপদ পানির আওতায় আছে। ২০১৫ সালে এর হার ছিল ৪৭ শতাংশ। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে পিছিয়ে নেপাল। দেশটির ১৬ শতাংশ মানুষ নিরাপদ পানি পায়। পাকিস্তানের ৪৫ শতাংশ মানুষ এখন নিরাপদ পানি পায়। এক দশক আগে এ হার ছিল ৪৪ শতাংশ। অর্থাৎ এক দশকে দেশটি মাত্র ১ শতাংশ এগিয়েছে।
আন্তর্জাতিক সংস্থা ওয়াটার এইডের বাংলাদেশীয় প্রধান হাসিন জাহান প্রথম আলোকে বলেন, ‘ভারত ও ভুটানের অগ্রগতির পেছনে সবচেয়ে বড় চালিকা শক্তি হলো রাজনৈতিক অগ্রাধিকার। ‘স্বচ্ছ ভারত’ কর্মসূচি ছিল দেশটির সরকারের অগ্রাধিকার। এদিকে নেপালও ২০৪১ সালের মধ্যে প্রতিটি ঘরে ট্যাপের পানি দেওয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। বাংলাদেশ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিয়ে খোলা স্থানে মলত্যাগের হার কমিয়ে এনেছিল। এটা বড় অর্জন। একই ধরনের প্রতিশ্রুতি ছাড়া বাংলাদেশের নিরাপদ পানির ক্ষেত্রে কোনো অর্জন সম্ভব নয়।’
বাংলাদেশ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিয়ে খোলা স্থানে মলত্যাগের হার কমিয়ে এনেছিল। এটা বড় অর্জন। একই ধরনের প্রতিশ্রুতি ছাড়া বাংলাদেশের নিরাপদ পানির ক্ষেত্রে কোনো অর্জন সম্ভব নয়।হাসিন জাহান, ওয়াটার এইডের বাংলাদেশীয় প্রধান
স্যানিটেশন খাতে কিছু আশা
পানির ক্ষেত্রে এক দশকে এগিয়ে যাওয়ার হার শ্লথ হলেও স্যানিটেশন খাতে অগ্রগতি কিছুটা দ্রুত। বছরে গড়ে ১ দশমিক ১ শতাংশ হারে। কিন্তু তাতেও বাংলাদেশে সর্বজনীন স্যানিটেশন নিশ্চিত হতে পারে ২০৮৩ সালের আগে নয়। সেই তুলনায় নেপাল ২০৪৯ সালে এবং ভারত ২০৪১ সালে এ লক্ষ্য পূরণে পৌঁছাতে পারবে।
জেএমপির ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে স্যানিটেশন কাভারেজ কিছুটা উন্নত হলেও এখনো প্রায় ৫ কোটি ৬০ লাখ মানুষ ন্যূনতম স্যানিটেশন–সুবিধা থেকেও বঞ্চিত। আর ২ কোটি মানুষ হাত ধোয়ার মৌলিক সুবিধা ছাড়াই বসবাস করছে।