জলবায়ু সংকট মোকাবিলায় বিজ্ঞানসম্মত কৌশলের সঙ্গে স্থানীয় মানুষের জ্ঞানের সম্মিলনে গুরুত্বারোপ

ফ্রুগাল ইনোভেশন ফোরামের (ফিফ) অষ্টম সম্মেলন। আজ শুক্রবার সাভারের ব্র্যাক সিডিএমেছবি: ব্র্যাকের সৌজন্যে

মনোবতী পার্বত্য চট্টগ্রামের জুমিয়া নারী। তিনি চার নাতি-নাতনির দাদি। মনোবতী ভেবেছিলেন, জীবনের শেষবেলাটা হবে বিশ্রামের—গান, নাচ আর উৎসবের সময়, কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। এখনো প্রতিদিন খেতে কাজে যেতে হয় তাঁকে। পরিশ্রম করতে হয় বেশ। এ বছর মনোবতীর জীবনের অন্যতম কঠিন বছর।

জুমে শসার আবাদ করেছেন মনোবতী। তিনি বললেন, শুরুতে বৃষ্টি কম ছিল। তাই শসাখেতে বেশি সার দিতে হয়েছিল। এরপর হুট করে কয়েক দিনের মধ্যে এত বেশি বৃষ্টি হলো যে শসাখেত নষ্ট হয়ে গেল। এখন মনোবতীর আশঙ্কা, তাঁর ধানও বুঝি একইভাবে নষ্ট হয়ে যাবে।

বৈরী প্রকৃতি, আবহাওয়ার এলোমেলো আচরণ, হঠাৎ বৃষ্টি কিংবা তীব্র খরা—এসব মনোবতীর মতো কৃষিনির্ভর মানুষদের এখন বড় বেশি ভাবাচ্ছে।

শুধু পাহাড়ের বাসিন্দারা নন, উপকূলীয় অঞ্চল কিংবা খরাপ্রবণ বরেন্দ্র অঞ্চলের মানুষও প্রকৃতির এই বৈরী আচরণের মুখোমুখি হচ্ছেন প্রতিনিয়ত। এ সমস্যা অবশ্য বৈশ্বিক। পুরো বিশ্ব এখন উষ্ণায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় ব্যস্ত। বাংলাদেশের মতো স্বল্প আয়ের দেশে এই সংকট আরও বেশি।

কিন্তু এসবের তো সমাধান চাই। কীভাবে হবে এর সমাধান? সংকট বড়, তাই সমাধানের পথও জটিল। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সহজ, টেকসই, বিজ্ঞানসম্মত কৌশলের সঙ্গে স্থানীয় মানুষের জ্ঞানের সম্মিলন ঘটিয়ে কৃষিসহ নানা খাতে আনতে হবে পরিবর্তন। এসব ভাবনা থেকে সৃষ্টি হয়েছে ফ্রুগাল ইনোভেশন ফোরামের। জলবায়ু সংকট নিরসনে সহজ ও সাশ্রয়ী উদ্ভাবনের জন্যই এ ফোরামের সৃষ্টি। বিশ্বের নানা দেশের বিশেষজ্ঞ, উদ্যোক্তা ও গবেষকেরা ফোরামের সদস্য।

ফ্রুগাল ইনোভেশন ফোরামের (ফিফ) অষ্টম সম্মেলন আজ শুক্রবার শুরু হয়েছে সাভারের ব্র্যাক সিডিএমে। দুই দিনব্যাপী এ সম্মেলনে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের দুই শতাধিক বিশেষজ্ঞ, উদ্যোক্তা, গবেষক ও উন্নয়নকর্মী অংশ নিচ্ছেন।

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ব্র্যাকের নির্বাহী পরিচালক আসিফ সালেহ বক্তব্য দেন
ছবি: ব্র্যাকের সৌজন্যে

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ব্র্যাকের নির্বাহী পরিচালক আসিফ সালেহ সম্মেলনের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য তুলে ধরেন। তিনি জলবায়ু পরিবর্তন ও এর টেকসই অভিযোজন কৌশল নিয়ে কথা বলেন। শুরুতে যে মনোবতীর কথা বলা হয়েছে, তাঁর উল্লেখ ছিল আসিফ সালেহের বক্তব্যের মধ্যেই।

‘কৃষি, খাদ্যনিরাপত্তা ও জীবিকায় জলবায়ু অভিযোজন’—এই প্রতিপাদ্য সামনে রেখে অনুষ্ঠিত হচ্ছে এবারের ফ্রুগাল ইনোভেশন ফোরাম। ব্র্যাকের উদ্যোগে আয়োজিত দুই দিনের সম্মেলনে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলায় গ্লোবাল সাউথ বা বিশ্বের এই প্রান্তের বাস্তবতার নিরিখে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর উদ্ভাবিত সমাধানগুলো নিয়ে বিশদ আলোচনা চলছে।

অনলাইনে যুক্ত হয়ে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর জোট ‘ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরামের’ মহাসচিব ও মালদ্বীপের সাবেক প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ নাশিদ। তিনি বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব দূরবর্তী কোনো বিষয় নয়, এর ভুক্তভোগী এখনই হচ্ছে মানুষ।

অনলাইনে যুক্ত হয়ে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর জোট ‘ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরামের’ মহাসচিব ও মালদ্বীপের সাবেক প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ নাশিদ
ছবি: প্রথম আলো

নিজ দেশের উদাহরণ টেনে মোহাম্মদ নাশিদ বলেন, বিশ্বের সবচেয়ে জলবায়ু ঝুঁকির মধ্যে থাকা একটি দেশ মালদ্বীপ। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে মাত্র দেড় মিটার উঁচুতে দেশটির অবস্থান। দ্বীপের প্রবালপ্রাচীর হুমকির মুখে পড়েছে।

জলবায়ু অর্থায়নে বৈষম্যের বিষয়টি উঠে আসে নাশিদের বক্তব্যে। তিনি বলেন, ধনী আর শিল্পনির্ভরদেশগুলো বৈশ্বিক উষ্ণায়নে মূল ভূমিকা রাখছে। কিন্তু এর দায় তারা নিচ্ছে না। তারা স্বচ্ছ জ্বালানির কথা বলে থাকে। কিন্তু এতে বিপুল অর্থায়ন দরকার, সেটা নিয়ে তারা মাথা ঘামায় না।

মোহাম্মদ নাশিদ বলেন, জলবায়ুর পরিবর্তনের সংকট রোধে বিজ্ঞাননির্ভর তৎপরতা খুব বেশি করে দরকার। কিন্তু এর সঙ্গে অবশ্যই স্থানীয় জ্ঞানকে সংযুক্ত করতে হবে। মতাদর্শ নয়, বিজ্ঞানেই আস্থা আনতে হবে। সমাধানের পথ হতে হবে সহজ ও সাশ্রয়ী।

প্যানেল আলোচনা

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের পর ব্র্যাক ও ব্র্যাক ইন্টারন্যাশনালের ক্লাইমেট হাবের ঊর্ধ্বতন পরিচালক ক্রিস্টিনা চ্যানের সঞ্চালনায় ‘ট্রান্সফরমেশনাল অ্যাডপটেশন ইন অ্যাগ্রিকালচার’ শীর্ষক প্যানেল আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়।

আজকের বাকি অধিবেশনগুলোর মধ্যে রয়েছে ব্র্যাক ইন্টারন্যাশনাল কেনিয়ার জলবায়ু কর্মসূচির জ্যেষ্ঠ ব্যবস্থাপক ডিজেফু গ্যাটাচোর সঞ্চালনায় ‘নেভিগেটিং আনসার্টেনটি থ্রু ক্লাইমেট ইনফরমেশন সার্ভিসেস’, ব্র্যাকের জ্যেষ্ঠ ব্যবস্থাপক কুলদীপ আরিয়ালের সঞ্চালনায় ‘ফার্মিং ফর দ্য ফিউচার: প্র্যাক্‌টিকেল ইনোভেশনস ফর স্মলহোল্ডার ফার্মারস’ শীর্ষক প্যানেল আলোচনা।

এ ছাড়া আজ ব্র্যাক ইন্টারন্যাশনালের ক্লাইমেট হাবের প্রধান অ্যাশলি টুম্বসের সঞ্চালনায় ‘ইউজ কেইসেস ফর গভর্নমেন্ট অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি’ এবং বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আনোয়ারুল আবেদীনের সঞ্চালনায় ‘নেচার বেইজড সল্যুশনস’ শীর্ষক অধিবেশন অনুষ্ঠিত হবে।

শেষ দিনের আয়োজন

আগামীকাল শনিবার এ আয়োজনের দ্বিতীয় ও শেষ দিন। সম্মেলনের সমাপনী অধিবেশনে বক্তব্য রাখবেন অন্তর্বর্তী সরকারের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। সমাপনী ভাষণ দেবেন ব্র্যাকের চেয়ারপারসন হোসেন জিল্লুর রহমান।

২০১৩ সালে যাত্রা শুরুর পর থেকে ফ্রুগাল ইনোভেশন ফোরাম গ্লোবাল সাউথভিত্তিক উদ্ভাবন ও সম্ভাব্য সমাধান নিয়ে আলোচনার জন্য অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্ল্যাটফর্ম হিসেবে কাজ করছে। এর আগের সম্মেলনগুলোয় ডিজিটাল আর্থিক অন্তর্ভুক্তি থেকে শুরু করে কোভিড–পরবর্তী পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া নিয়েও আলোচনা হয়েছে।

বিশ্বজুড়ে জলবায়ু সংকট বাড়ছে। সেই সঙ্গে অভিযোজনের জন্য অর্থায়ন কমে আসছে। এই প্রেক্ষাপটে এবারের ফ্রুগাল ইনোভেশন ফোরাম যে বার্তাটি দিচ্ছে, সেটি হলো কেবল জনগণের জন্য নয়, বরং তাদের সঙ্গে নিয়ে তৃণমূল পর্যায় থেকেই জলবায়ু সহনশীল ভবিষ্যৎ গড়ে তুলতে হবে।