অর্কিড রক্ষায় অনন্য উদ্যোগ

আমগাছে ঝোলানো টবে ফক্সটেইল অর্কিড
ছবি: লেখক

রাঙামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলার রুইলুই পাড়া, হামারি পাড়া ও কংলাক পাড়া। এই তিন পাড়ার সমন্বয়ে গড়ে ওঠা ‘সাজেক’ ইউনিয়ন পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয় পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠেছে। কিন্তু এই পর্যটনকেন্দ্রকে পর্যটকবান্ধব করতে প্রকৃতির যে বিনাশ ঘটেছে, তা অনেকেরই অজানা।

হোটেল, মোটেল ও সড়কের জন্য এই সুউচ্চ টিলাটির ঝোপজঙ্গল কেটে পরিষ্কার করা হয়েছে। কাটা পড়েছে অনেক মহিরুহ বৃক্ষ। এলাকাটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্ভিদ ও প্রাণীদের স্পর্শকাতর আবাসস্থল হিসেবেও চিহ্নিত ছিল। প্রকৃতিপ্রেমী অর্কিড সংগ্রাহক সাথোয়াই মারমা আমাকে যা বললেন, ওপরের কথাগুলো তারই সারমর্ম।

সম্প্রতি সাজেক থেকে ফিরে এসে গিয়েছিলাম খাগড়াছড়ি জেলা শহরের রাজ্যমনি পাড়ায় সাথোয়াই মারমার বাড়ি। তাঁর বাড়ির উঠানে বসে এসব কথা হচ্ছিল। তিনি জানালেন, এমন একটি পরিস্থিতিতে প্রায় আট বছর আগে সাজেকের কেটে ফেলা সুবিশাল গাছগুলো থেকে অর্কিড সংগ্রহ শুরু করেন। এরপর বাড়ির গাছগুলোতে লাগিয়ে রাখেন। পরবর্তী সময়ে বান্দরবানের ডিম পাহাড়, থানচি ও রেমাক্রি এলাকায় কেটে ফেলা গাছ থেকেও একইভাবে অর্কিড সংগ্রহ করেন তিনি।

তেঁতুলগাছে সংরক্ষণ করা হয়েছে অ্যারাইডিস মাল্টিফ্লোরা প্রজাতির অর্কিড

এভাবেই পাহাড়ের বিপন্ন ও দুষ্প্রাপ্য অর্কিড সংগ্রহে সূচনা তাঁর। এরপর প্রতিষ্ঠা করেন ‘হিল অর্কিড সোসাইটি’। বিপন্ন অর্কিড সংগ্রহের পাশাপাশি অর্কিড পাচারকারীদের প্রতিহত করাও এই সংগঠনের অন্যতম লক্ষ্য। কিছুদিন পর তাঁর সঙ্গে যোগ দেন আরও দুই অর্কিডপ্রেমী কমলছড়ি পাড়ার দিপন চাকমা ও নারান খাইয়া পাড়ার কৌশল চাকমা। তত দিনে সাথোয়াই মারমা শহরের ইটছড়িতে দাদার বাড়িতেও আরেকটি সংগ্রহশালা গড়ে তোলেন।

আট বছর ধরে সাথোয়াই মারমার নেতৃত্বে রাজ্যমনি পাড়া, কমলছড়ি পাড়া, নারান খাইয়া পাড়া ও ইটছড়িতে এই অর্কিড সংগ্রহশালা গড়ে উঠেছে। কোনো ধরনের পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়াই পাহাড়ের বিভিন্ন বন ঘুরে বিরল জাতের এসব অর্কিড সংগ্রহ করেছেন তাঁরা। সাকুল্যে চারটি স্পটে এখন তাঁদের সংগ্রহ ৬৫ প্রজাতির দুর্লভ অর্কিড। সংগৃহীত এবং সংরক্ষিত এসব অর্কিডের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলোÑডেন্ড্রোবিয়াম পারিশি, ডেন্ড্রোবিয়াম টরটাইল, ডেন্ড্রোবিয়াম মসছাটাম, ডেন্ড্রোবিয়াম ফিম্ব্রিয়াথাম, ডেন্ড্রোবিয়াম লিটুইফ্লোরাম, ডেন্ড্রোবিয়াম পিয়েরাড্ডি, অ্যারাইডিস ওডোরাটা, অ্যারাইডিস মাল্টিফ্লোরা, ক্রিপিডেটাম, ডেন্ড্রোবিয়াম ফরমোসাম, ডেন্ড্রোবিয়াম ফার্মেরি, ফাইলোনপসিস কর্নু সার্ভি, ফাইলোনপসিস ডেলিকোসা, ফলিডোটা পালিদা, পাপিলিওনানথে তেরেস, রাইনকোস্টালিস রিটুসা, এরিয়া টেমেনটোসা, এরিয়া ব্রাকটেন্সেস, এরিয়া প্রামোরসা, একেম্পে ওক্রাশিয়া, সিলোজিনি ট্রিনারভিস, সিলোজিনি ভিসকোসা, সিলোজিনি ফিম্ব্রিয়াটা, সিলোজিনি প্রোলিফেরা, বাল্বোফাইলাম ক্রাসিপেস, বাল্বোফাইলাম ওডোরাটিসিমাম, ডেন্ড্রোবিয়াম পাচুপাইলাম, পিনালিয়া, ডেন্সিফ্লোরামস, ট্রান্সপারেন্স, ডেন্ড্রোবিয়াম এফেমেরান্টে, এনসেপ, বাল্বোফাইলোম রক্সবার্গি, ইনসেক্টিফেরা, পালেন্স, মাইক্রোপেরা, লিপারিস ভিরিডিফ্লোরা, জিওডোরাম পার্পোরাম, অরুন্ধিনা, ইলোফিয়া ইত্যাদি। এর মধ্যে ডেন্ড্রোবিয়াম মসছাটাম মহাবিপন্ন একটি অর্কিড। বাহারি রঙের এই অর্কিডগুলো টবের পরিবর্তে শোভা পাচ্ছে কৃষ্ণচূড়া, তেঁতুল, আম, জারুল, কাঠগোলাপ, সোনালু, কাঁঠালসহ বিভিন্ন গাছে।

কৃষ্ণচূড়াগাছে সংরক্ষণ করা হয়েছে ডেন্ড্রোবিয়াম পারিশিসহ অন্যান্য অর্কিড

যতটা সহজে এই কথাগুলো বলা হলো, কাজটি কিন্তু ততটা সহজ ছিল না। যেখানে বন, বন্য প্রাণী এবং বনজ সম্পদই রক্ষা করা দায়, সেখানে আবার অর্কিড রক্ষা তো বিলাসিতার শামিল! নিজেদের চোখের সামনে সুদৃশ্য অর্কিডগুলো বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে—এমন একটি হতাশাজনক পরিস্থিতি তাঁদের আজ এই বাস্তবতায় দাঁড় করিয়েছে।

চার দশক আগেও পাহাড়ের পাদদেশে বড় গাছগুলোতে বিভিন্ন রঙের ফুল দেখা যেত। বর্তমানে অপরিকল্পিত জুমচাষ, অর্কিড পাচার, বনাঞ্চল উজাড়সহ বিভিন্ন পরিবেশ–বিধ্বংসী কর্মকাণ্ডের কারণে প্রাকৃতিক আবাস থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে অর্কিড। পাহাড়ের মানুষও অর্কিড সম্পর্কে যথেষ্ট সচেতন নন। অনেকে অজ্ঞতাবশত পরগাছা বা আগাছা ভেবে মূল্যবান অর্কিডগুলো নষ্ট করেন। অথচ একসময় দেশের প্রাকৃতিক আবাসে প্রায় ২০০ প্রজাতির অর্কিড জন্মাত। যার সিংহভাগই দেখা যেত পাহাড়ে।

‘প্ল্যান্টেশন ফর নেচার’-এর প্রতিষ্ঠাতা প্রকৌশলী সবুজ চাকমা বলেন, ‘কোনো বাণিজ্যিক উদ্দেশ্য ছাড়া অর্কিডকে বাঁচানোর জন্য ব্যক্তিপর্যায়ে অর্কিড সংরক্ষণ করাকে আমি ইতিবাচকভাবে দেখি। বন্য প্রাণী আইন, ২০১২–এর তফসিল ৪-এ বর্ণিত ধারা অনুযায়ী ১৩ প্রজাতির অর্কিডকে ইচ্ছাকৃতভাবে ওঠানো, উপড়ানো, ধ্বংস বা সংগ্রহ করার বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। এই প্রজাতিগুলো বাদে আইনের মধ্যে থেকে অর্কিড সংরক্ষণ করা একটি সময়োপযোগী পদক্ষেপ। তবে সংরক্ষণের নামে যারা অর্কিড পাচার করছে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত।’

সাথোয়াই মারমার এই উদ্যোগকে আরও শক্তিশালী করার জন্য প্রাতিষ্ঠানিক পৃষ্ঠপোষকতা দরকার। জেলা প্রশাসন থেকেও এ বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। তাহলে অনন্য এই উদ্যোগ একটি পূর্ণাঙ্গ রূপ পাবে।

  •  মোকারম হোসেন, প্রকৃতি ও পরিবেশবিষয়ক লেখক