সুবলংয়ের শ্বেত-শুভ্র দুধকলমি
রাঙামাটি শহর থেকে নৌযানে চেপে সুবলংয়ের পথে অনেকবার গিয়েছি। প্রতিবার একই মুগ্ধতা নিয়ে দুই পাশের অসাধারণ সৌন্দর্য উপভোগ করেছি। কোলাহলের বাইরে এমন জনবিচ্ছিন্ন অলৌকিক সুবর্ণভূমি আমাদের দেশে খুব একটা নেই। যতবার এপথে গিয়েছি, ততবারই দুই পাশের দৃশ্যাবলি নতুন মনে হয়েছে। আসলে পছন্দের জায়গাগুলো কখনোই পুরোনো হয় না। ১৯৮৭ সালে প্রথম এই পথে যাত্রা। ৩৬ বছরের ব্যবধানে আরও কতবার যে যাওয়া হয়েছে! কিন্তু ক্লান্তি লাগে না। এবারও আকর্ষণ সেই আগের মতো!
সকালে বনরূপা বাজার থেকে ভরপেট নাশতা খেয়ে ট্রলারে উঠি। চনমনে রোদে বাতাস কেটে চলছে নৌকা। কিছুক্ষণ পর থামতে হলো। যাওয়ার পথেই নির্দিষ্ট রেস্তোরাঁয় দুপুরের খাবারের ফরমাশটা দিতে হবে। কাজ শেষে আবার নৌকায় ফিরি। শুরু হলো মধুর পথচলা।
নিস্তব্ধতার বুক চিরে মোটরের কর্কশ শব্দ কেবল পাহাড়ের গায়ে প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে আসছে। সহযাত্রীরা ছবি তোলায় ব্যস্ত। কিন্তু বাস্তবে যতটা মুগ্ধতা নিয়ে দেখা হয়, ছবি বা ভিডিওতে তার সিকি ভাগও অনুভব করা যায় না। মাঝেমধ্যে কোনো বিশেষ দৃশ্য দৃষ্টিগোচর হলে নৌকার গতি কমিয়ে আনা হচ্ছে।
কখনো কখনো অলংকৃত পাথুরে দেয়ালের প্রাকৃতিক শিল্পকর্ম, কখনো আবার বিচিত্র উদ্ভিদের কারুকার্যময় শোভা খুঁটিয়ে দেখছে সবাই। এসব দেখতে দেখতে প্রায় দুপুর গড়িয়ে এল। নৌকা এসে সুবলং ঝরনার কাছে থামল। ঝরনায় পানির প্রবাহ ততটা জোরালো নয়। মন সায় দিল না নামতে। কিন্তু সহযাত্রীরা অনড়। একেবারে কাছ থেকে তাদের ঝরনা দেখা চাই। অগত্যা আমিও নামলাম।
ঢাল বেয়ে খানিকটা উঠে আবার নামতে গিয়েই শ্বেত-শুভ্র রঙের এই ফুলটি চোখে পড়ল। ভালোভাবে তাকিয়ে দেখি একগুচ্ছ নাদুসনুদুস লতা ছড়িয়ে আছে অনেক দূর অবধি। লতার ফাঁক গলে উঁকি দিচ্ছে কয়েকটি সাদা রঙের ফুল। ফুলের পাপড়ি গভীরভাবে খাঁজকাটা হওয়ায় চিনতে কিছুটা সমস্যা হলো। ঢাকায় ফিরে ফুলটির নাম ঠিকুজি খুঁজে বের করি। প্রচলিত নাম দুধকলমি।
বছর তিনেক আগে গাছটি লক্ষ্মীপুরে মেঘনার চরে ঝোপঝাড়ের ভেতর দেখেছি। গাছে ফুল ছিল না। ছিল কতগুলো মেরুন রঙের কলি। বাংলাদেশ উদ্ভিদ ও প্রাণী জ্ঞানকোষ-এর তথ্যমতে, বরগুনা, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, ঢাকা, পটুয়াখালী ও রাঙামাটি জেলায় এই গাছ প্রাকৃতিকভাবেই জন্মে। তবে গত ২৫ বছর দেশের প্রত্যন্ত এলাকায় উদ্ভিদ সমীক্ষার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, এ গাছ সংখ্যায় খুবই কম।
দুধকলমি (Operculina turpethum) লতানো গাছ। মাটিতে গড়াতেই পছন্দ। মূল রসাল ও শাখান্বিত। ফুল পর্যায়ক্রমে, সাইম মঞ্জরিতে বিন্যস্ত, মঞ্জরিদণ্ড লম্বা, কখনো পক্ষবৎ কাণ্ডের মতো, মঞ্জরিপত্র দীর্ঘায়ত বা উপবৃত্তাকার দীর্ঘায়ত, আশুপাতী।
বৃত্যংশ অসম, ডিম্বাকার থেকে প্রশস্ত ডিম্বাকার, সূক্ষ্মাগ্র থেকে দীর্ঘাগ্র ও পেয়ালাকৃতি। বীজ ত্রিকোণাকার বা গোলাকার, আড়াআড়ি ৬ মিলিমিটার ও কালচে রঙের। ফুল ও ফলের মৌসুম অক্টোবর থেকে মে মাস পর্যন্ত বিস্তৃত।
এ গাছের বাকল রেচক, কোষ্ঠকাঠিন্য, অর্শ ও পেশির ব্যথায় ব্যবহার্য। লতানো কাণ্ড জিনিসপত্র বাঁধার কাজে ব্যবহৃত হয়।
মোকারম হোসেন, প্রকৃতি ও পরিবেশবিষয়ক লেখক