নীলচিতা, চিতা ও রক্তচিতা

নীলচিতা

প্রায় এক দশক আগের কথা। উদ্ভিদবিষয়ক একটি ফিল্ডগাইড তৈরির জন্য প্রতিদিনই কিছু না কিছু রসদপত্র জোগাড় করছি। সাধারণ পাঠকদের কথা বিবেচনায় রেখে কিছু বাড়তি ছবি যোগ করার জন্য বিভিন্ন স্পটে যাচ্ছি ছবি তোলার জন্য। এমন সময়ই যাওয়া হলো গাজীপুরের হাতিয়াবোয় একটি শালবনে। বন লাগোয়া ‘আরণ্যক’ নামের বনবাড়িটি আগে থেকেই চেনা।

প্রধান ফটক পেরিয়ে গাড়িবারান্দায় ঢোকার মুখে চোখে পড়ল নীল রঙের একরাশ ফুল। ফুলটি ততটা প্রচলিত নয়। বিচ্ছিন্নভাবে কোথাও কোথাও দেখেছি। উদ্ভিদবিষয়ক বইয়ে এ ফুলের নাম নালচিতা হলেও সবার কাছে নীলচিতা বা নীলচিত্রক নামেই পরিচিত।

রঙের জৌলুশ এবং প্রস্ফুটন প্রাচুর্য এ ফুলের বিশেষ বৈশিষ্ট্য। এ কারণে অনেক দূর থেকেই ফুলটি আমাদের আকৃষ্ট করতে পারে। মনোলোভা রঙের কারণে ইদানীং প্রায় সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। ঢাকার বাইরে বেশি দেখা যায় চট্টগ্রাম ও খুলনায়। নীলচিতা পৃথিবীর নানান দেশে বাড়ির আঙিনা, বাগান এবং বাণিজ্যিক ভূসজ্জায় বহুল ব্যবহৃত। সব মিলিয়ে সারা বিশ্বে এই প্রজাতির ১০টি রকমফের দেখা যায়।

সাদাচিতা বা চিত্রক

নীলচিতা (Plumbago capensis) চিরসবুজ ঝোপালো ধরনের গুল্ম শ্রেণির গাছ। জন্মস্থান দক্ষিণ আফ্রিকায়, গাছটি প্রায় ছয় মিটার পর্যন্ত উঁচু। পাতা চকচকে সবুজ, দুই ইঞ্চি পর্যন্ত লম্বা হতে পারে। হালকা বা গাঢ় নীল রঙের এই ফুলের প্রস্ফুটন মৌসুম শরৎ থেকে হেমন্ত পর্যন্ত। শাখার মাথায় পাঁচ পাপড়ির গুচ্ছবদ্ধ ফুলগুলো এক ইঞ্চির মতো লম্বা হতে পারে। গাছটি ভেষজ গুণেও অনন্য। সাধারণত মাথাব্যথা, হাড়ভাঙা, আঁচিল ও ক্ষত চিকিৎসায় এই গাছ ব্যবহৃত হয়। আফ্রিকার আদিবাসীরা দুঃস্বপ্ন তাড়াতে এবং বজ্রপাত এড়াতে গাছটির তান্ত্রিক ব্যবহার করে থাকে।

সাদা রঙের চিতা দেখেছি পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ায় একটি চা-বাগানের প্রান্তে। স্থানীয়ভাবে চিতা বা চিত্রক নামে পরিচিত। নীলচিতার তুলনায় সংখ্যায় অনেক কম। এ কারণে গাছটিকে বিরল মনে করা হয়। এই চিতা (Plumbago zeylanica) বহুবর্ষজীবী বীরুৎ বা ছোট ধরনের গুল্ম শ্রেণির উদ্ভিদ।

শাখাগুলো আড়াই মিটার পর্যন্ত লম্বা, বেলনাকার, মসৃণ, সোজা এবং সুগঠিত অনেক মুকুলবিশিষ্ট। শিকড় মোটা এবং কাষ্ঠল। পাতা ডিম্বাকার থেকে উপবৃত্তাকার, অখণ্ড এবং তীক্ষ্ণèথেকে দীর্ঘাগ্র। ফুল সাদা, পুষ্পবৃত্ত খাটো, সরু, কিছুটা শাখান্বিত, স্থায়ী এবং ঝিল্লিময় কিনারাবিশিষ্ট। ফোটার মৌসুম হেমন্ত থেকে শীতের প্রথম ভাগ পর্যন্ত। দলনল ২ দশমিক ২ সেন্টিমিটারের মতো লম্বা। পাপড়ি ৬ থেকে ৭ মিলিমিটার লম্বা, বিডিম্বাকার।

রক্তচিতা
ছবি: মোকারম হোসেন

সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ উদ্যানে মৌসুমি ফুলের বিচিত্র শোভার ভেতর রক্তচিতার নান্দনিক সৌন্দর্য নজর কাড়ে। বর্ণিল উদ্যান তৈরিতে এই ফুল অনন্য। রক্তচিতা (Plumbago indica) বহুবর্ষজীবী ছোট গুল্ম বা ক্ষুদ্র আকারের আরোহী, প্রায় পাঁচ ফিট পর্যন্ত উঁচু হতে পারে। গাছের গা আঠালো, পাতা সরল ও একান্তর। পাতার আকার মোটামুটি ডিম্বাকৃতি। পুষ্পবিন্যাস ডালের আগায়, কখনো কখনো পার্শ্ববর্তী। বৃতিও কিছুটা আঠালো। ফুল লালচে রঙের, পাপড়িসংখ্যা পাঁচ। ফুল ও ফলের মৌসুম ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত বিস্তৃত।

রক্তচিতা অপ্রচলিত ধরনের উদ্ভিদ হলেও ভেষজ গুণে অনন্য। এই গাছের মূল ও পাতা টিউমার, দাঁতব্যথা, গ্যাস্ট্রিক, যকৃৎ সমস্যা ও গর্ভনিরোধে অত্যন্ত কার্যকর। শরীরের কোনো স্থানে টিউমার হলে পাতা বেটে ওপরে লাগাতে হয়। দাঁতে ব্যথা হলে শিকড় চিবিয়ে মুখের ভেতর কিছুক্ষণ রাখলে উপশম হয়। গ্যাস্ট্রিক ও সূতিকায় গাছের পাতা চূর্ণ করে বড়ি বানিয়ে এক সপ্তাহ পর্যন্ত ভরা পেটে সকাল–বিকেল একটি করে বড়ি খেতে হয়।

সব প্রজাতির চিতাগাছই বিষাক্ত ধরনের। গাছের যেকোনো অংশ গিলে ফেললে রক্তে বিষক্রিয়া হতে পারে। আবার গাছটির রস গায়ে লাগলে ত্বকে তীব্র অ্যালার্জিক প্রদাহ হতে পারে। এসব কারণে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখেই অপরূপ এই চিতার সৌন্দর্য উপভোগ করা উত্তম।

  • মোকারম হোসেন, প্রকৃতি পরিবেশবিষয়ক লেখক