এপ্রিলের শেষ ভাগে হাওর এলাকায় ধান কাটার মৌসুম। আগাম বন্যা আসার ঝুঁকি থাকায় কৃষকদের ব্যস্ততার শেষ নেই। এ সময় টাঙ্গুয়ার হাওরে গিয়েছি মৌসুমের শেষ সময়ের পরিযায়ী পাখি দেখতে। হাওরে তেমন কোনো জলচর পরিযায়ী প্রজাতি নেই। একদল বড় গাঙচিল আর পানচিল আছে। তবে হাওরে ঢোকার মুখেই দেখতে পেলাম, প্রায় ৩০০ কালালেজ জৌরালি পাখির একটি বড় দল। পালকে প্রজনন মৌসুমের রং এসেছে। পাখিগুলোর কোনো দিকে নজর দেওয়ার সময় নেই যেন। বেশি করে খাবার খাচ্ছে আর দেহের চর্বি বাড়াচ্ছে। যেকোনো সময় হাওরে পানি ঢুকবে। আর তাদের খাবারের জায়গাগুলো পানির নিচে তলিয়ে যাবে। তখন এদের লম্বা পথের পরিযায়ন যাত্রা শুরু করতে হবে। বছরে দুইবার পাখিগুলোকে এই কাজ করতে হয়। শীতের শুরুতে প্রজাতিটি মধ্য এশিয়ার বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রজনন শেষে এ দেশে আসে এবং আর গরমের শুরুতে আবার ফিরে যায় তাদের প্রজননভূমিতে।
কালালেজ জৌরালির চারটি উপপ্রজাতির মধ্যে তিনটিই দেখা যায় বাংলাদেশে। ছোট্ট সৈকত পাখি প্রজাতিটির ওজন মাত্র ৩০০ গ্রামের মতো। এই পাখিই প্রায় চার হাজার কিলোমিটার পথ পাড়ি দেয় বছরে দুবার। তার মানে, পাখিটি বছরে অন্তত আট হাজার কিলোমিটার পথ পরিযায়ন করে।
আমাদের দেশে জৌরালিদের মূলত দুই এলাকাতে দেখা যায়। মিঠাপানির জলাশয় ও উপকূলীয় এলাকায়। টাঙ্গুয়ার হাওরে শীতকালে দুই-তিন হাজার জৌরালির একটি বড় দল ১৬ বছর ধরে নিয়মিত দেখে আসছি। এখানে পাখির দলটি থাকে মূলত চার মাস। পৃথিবীর কোন অঞ্চল থেকে এই পাখির দল এখানে আসে, তা জানার খুব ইচ্ছা ছিল। পাঁচ বছর আগে এই পাখিদের পায়ে আমরা রিং পরানো শুরু করি। তিন বছর ধরে একটি পাখির পিঠে স্যাটেলাইট যন্ত্র বসিয়ে এর গতিবিধি দেখছি। কী অসাধারণ তাদের ভ্রমণপথ! একটি পাখিতে যন্ত্রটি বসানোর পর পুরো শীতকাল পাখিটি কাটাল টাঙ্গুয়ার হাওরে। পরিযায়ন করার শুরুতেই সে চলে গেল নিঝুম দ্বীপ এলাকায়। সেখানে প্রায় ১৫ দিন কাটানোর পর আবার সিলেট অভিমুখে যাত্রা করে। এরপর সোজা চলে যায় চীনের একটি লেকে। তার এই ভ্রমণ দেখে অভিভূত হয়ে গেলাম।
কালালেজ জৌরালির ওপর একটি দীর্ঘ গবেষণা করছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক পাখিবন্ধু দিলীপ দাশ। তিনি অর্ধশতাধিক পাখির গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করছেন। তিনি নেদারল্যান্ডসের বিখ্যাত গ্রোনিনগেন বিশ্ববিদ্যালয়ে এই পাখির পরিযায়নের ওপর পিএইচডি করছেন। তাঁর গবেষণায় আরও একটি বিষয় উঠে আসছে যে এই পাখিগুলো কেন উপকূল ও মিঠাপানির জলাশয় ব্যবহার করে। তিনি দেখেছেন, এ দেশে আসা তিনটি উপপ্রজাতি পৃথিবীর তিনটি ভিন্ন ভিন্ন এলাকায় প্রজননের জন্য যায়। আবার তিনটি দলই ভিন্ন ভিন্ন পথে বাংলাদেশে আসে। প্রথম দলটি পূর্ব কাজাখস্তানের করিকশা ও তার পার্শ্ববর্তী মঙ্গোলিয়া-রাশিয়া অঞ্চলের ঘাসবনে প্রজনন শেষ করে আগস্ট মাসে বাংলাদেশের পথে যাত্রা শুরু করে। প্রায় ৩০ দিনে তিন-চারবার বিশ্রাম নিয়ে পাখিগুলো বাংলাদেশের উপকূলের নিঝুম দ্বীপে পৌঁছায়। দ্বিতীয় আরেকটি দল রাশিয়ার তুন্দ্রা অঞ্চলে প্রজনন শেষ করে বৈকাল হ্রদ হয়ে হিমালয়ের কাঞ্চনজঙ্ঘা পাড়ি দিয়ে এ দেশের উপকূলে পৌঁছায়। আর তৃতীয় দলটি চীন ও মঙ্গোলিয়ার পূর্ব সীমান্তের ঘাসবনে প্রজনন করে তিব্বত হয়ে হিমালয় পাড়ি দিয়ে ভারতের অরুণাচলে আসে। তারপর এরা বাংলাদেশে উপকূলে চলে আসে।
আমাদের দেশে প্রতিবছর সব মিলিয়ে প্রায় ১০ হাজার কালালেজ জৌরালি পরিযায়ী হয়ে আসে। এ দেশে প্রায় ৬০ প্রজাতির সৈকত পাখি আছে। এর মধ্যে সবচেয়ে লম্বা পথে পরিযায়ন করা সৈকত পাখির একটি হলো এই কালালেজ জৌরালি।
আজ ১১ মে, বিশ্ব পরিযায়ী পাখি দিবসের প্রতিপাদ্যে পোকামাকড় পরিয়ায়ী পাখির জন্য যে বিশেষ ভূমিকা রাখে, তার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এ দেশের সৈকত পাখির অনেক প্রজাতি পোকামাকড় খেয়ে বেঁচে থাকে। পরিযায়ী পাখি রক্ষায় আমাদের উপকূল আর মিঠাপানির হাওর এলাকার ঘাসবনগুলো রক্ষা করতে হবে। তাতে পোকার আবাসভূমি রক্ষা পাবে আর সঙ্গে সঙ্গে পরিযায়ী পাখির খাবারও নিশ্চিত হবে।