দূষণ আগরতলায়, ভুগছে ব্রাহ্মণবাড়িয়া
যৌথ নদী কমিশনের বৈঠকে গত মার্চে দূষণ বন্ধের আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল। অবশ্য পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি।
দূষণের কারণে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া উপজেলায় জনজীবনে নানা ধরনের ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া সীমান্তের ওপারে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য। রাজ্যটির রাজধানী আগরতলায় শিল্প ও গৃহস্থালি বর্জ্যে সেখানকার নদী ও খাল দূষণের শিকার হচ্ছে। সেই দূষিত পানি আসছে বাংলাদেশে। ভুগছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মানুষ।
১৮ ডিসেম্বর আখাউড়া সীমান্তে গিয়ে দেখা যায়, ইমিগ্রেশন চেকপোস্টের পাশ দিয়ে ভারত থেকে বাংলাদেশে এসেছে কালন্দি খাল। সেই খাল দিয়ে আসছে কুচকুচে কালো পানি। আশপাশে তীব্র দুর্গন্ধ। চিকিৎসক ও স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, দীর্ঘদিনের এ দূষণে ত্বক ও পেটের পীড়ায় আক্রান্ত হচ্ছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া উপজেলার ১৫ গ্রামের মানুষ।
আগরতলার শিল্প ও গৃহস্থালি বর্জ্যে দূষিত হয়ে পড়েছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পাঁচটি খাল ও দুটি নদী।
সব মিলিয়ে পাঁচটি খাল ও দুটি নদী দূষণের শিকার হচ্ছে। সেগুলো হলো কালন্দি, মরা গাঙ, কাটা খাল, কালিকাপুর ও গঙ্গাসাগর খাল এবং হাওড়া ও জাজী নদী।
দূষণ নতুন নয়, তিন দশক ধরে চলছে। এ বছরের মার্চে অনুষ্ঠিত যৌথ নদী কমিশনের বৈঠকে ভারতের পক্ষ থেকে দূষণ বন্ধের আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল বাংলাদেশকে। তবে পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি।
২০২০ সালে পরিবেশ অধিদপ্তরের একটি কমিটি প্রথমবারের মতো এসব খাল ও নদীর পানি পরীক্ষা করে দূষণের প্রমাণ পায়। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, ভরা বর্ষাতেও সীমান্তবর্তী বাংলাদেশ অংশের খালগুলোতে দূষণ ছিল মাত্রাতিরিক্ত। দূষণের প্রভাব তিতাস নদ পর্যন্ত পৌঁছেছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছিল।
কমিটির প্রতিবেদনে দূষণ বন্ধে ভারতীয় অংশে বর্জ্য পরিশোধনাগার (সুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট ও অ্যাফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট) বসানোর ব্যবস্থা নিতে ভারতের সঙ্গে আলোচনা করার সুপারিশ করা হয়। সর্বশেষ পরিবেশ অধিদপ্তর গত এপ্রিলেও পানি পরীক্ষা করে। সেখানেও দূষণ পাওয়া যায়।
২০২০ সালের কমিটির প্রধান ছিলেন পরিবেশ অধিদপ্তরের তৎকালীন পরিচালক ফাহমিদা খানম। তিনি এখন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘২০২০ সালের অক্টোবরে আমরা প্রথম সীমান্তবর্তী খাল ও নদীর পানির নমুনা পরীক্ষা করে মানমাত্রা–বহির্ভূত দূষণ পাই। তখন আমরা পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে এটি নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করার ব্যবস্থা করেছিলাম।’
ফাহমিদা বলেন, ‘আমাদের পক্ষ থেকে তখন যৌথ নদী কমিশনকে এসব দূষণ বন্ধে ব্যবস্থা নিতে ভারতের সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য বলি। তারা নিয়মিত বিষয়টি কমিশনের বৈঠকে উত্থাপন করে আসছে। সর্বশেষ ফলাফল কী, সেটা যৌথ নদী কমিশন ভালো বলতে পারবে।’
২০২০ সালের অক্টোবরে আমরা প্রথম সীমান্তবর্তী খাল ও নদীর পানির নমুনা পরীক্ষা করে মানমাত্রা–বহির্ভূত দূষণ পাই। তখন আমরা পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে এটি নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করার ব্যবস্থা করেছিলাম।পরিবেশ অধিদপ্তরের তৎকালীন পরিচালক ফাহমিদা খানম
জানতে চাইলে যৌথ নদী কমিশনের পরিচালক প্রকৌশলী মোহাম্মদ আবু সাঈদ প্রথম আলোকে বলেন, কয়েক বছর ধরে যৌথ নদী কমিশনের সভায় দূষণ বন্ধে ব্যবস্থা নিতে ভারতকে বলা হচ্ছে। প্রতিবারই ভারত দূষণ বন্ধে পদক্ষেপ নেওয়ার আশ্বাস দেয়। বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) মহাপরিচালক পর্যায়ের বৈঠকেও দূষণ বন্ধে পদক্ষেপ নিতে বলা হয়েছে।
মোহাম্মদ আবু সাঈদ আরও বলেন, সর্বশেষ এ বছরের মার্চে অনুষ্ঠিত যৌথ নদী কমিশনের সভায় ভারত জানিয়েছে, দূষণ বন্ধে আগরতলা শহরে সুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট বসানোর কাজ শুরু হয়েছে। এটি নির্মাণাধীন। কাজ শেষে বাংলাদেশ থেকে একটা দলের সেটি পরিদর্শনে যাওয়ার কথা রয়েছে।
পানিতে জৈব দূষণ কতটা, তা মাপার সূচক হচ্ছে বিওডি (বায়োকেমিক্যাল অক্সিজেন ডিমান্ড)। এটির গ্রহণযোগ্য মানমাত্রা হলো প্রতি লিটারে সর্বোচ্চ ৬ মিলিগ্রাম। সাতটি নমুনার সব কটিতেই গ্রহণযোগ্য মাত্রার বেশি পাওয়া গেছে। পরিমাণ ৮ থেকে ২৭ মিলিগ্রাম।
দূষণের চিত্র
পানিতে জলজ প্রাণী ও অণুজীবের শ্বাস নেওয়ার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় উপাদান হলো দ্রবীভূত অক্সিজেন। প্রতি লিটারে দ্রবীভূত অক্সিজেন (ডিও) দরকার অন্তত ৫ মিলিগ্রাম।
পরিবেশ অধিদপ্তরের এ বছরের এপ্রিলের পরীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, ৭টি জায়গা থেকে নেওয়া নমুনার ৬টিতেই দ্রবীভূত অক্সিজেন গ্রহণযোগ্য মাত্রার চেয়ে অনেক কম পাওয়া গেছে। ৫টিতে পাওয়া গেছে শূন্য দশমিক ৬১ থেকে ১ দশমিক ২০ মিলিগ্রামের মধ্যে। একটি জায়গায় এ হার ছিল ৪ দশমিক ১৫ মিলিগ্রাম। গ্রহণযোগ্য মানমাত্রায় পাওয়া গেছে একটি জায়গায়।
পানিতে জৈব দূষণ কতটা, তা মাপার সূচক হচ্ছে বিওডি (বায়োকেমিক্যাল অক্সিজেন ডিমান্ড)। এটির গ্রহণযোগ্য মানমাত্রা হলো প্রতি লিটারে সর্বোচ্চ ৬ মিলিগ্রাম। সাতটি নমুনার সব কটিতেই গ্রহণযোগ্য মাত্রার বেশি পাওয়া গেছে। পরিমাণ ৮ থেকে ২৭ মিলিগ্রাম।
দূষণের মাত্রা পরীক্ষার আরেকটি সূচক হলো সিওডি (কেমিক্যাল অক্সিজেন ডিমান্ড)। পানিতে সিওডি থাকতে হয় প্রতি লিটারে সর্বোচ্চ ৫০ মিলিগ্রাম। সাতটি নমুনার মধ্যে একটিতে সিওডি গ্রহণযোগ্য মাত্রায় পাওয়া গেছে। ছয়টিতে পাওয়া গেছে বেশি, ৫২ থেকে ১১৬ মিলিগ্রাম।
আখাউড়া প্রকৃতি ও পরিবেশ ক্লাবের আহ্বায়ক রুবেল আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ভারত থেকে দূষিত পানি আসছে। বিগত তিন দশকে দূষণ বেড়েছে।
স্বাস্থ্যের ক্ষতি, সম্পদের ক্ষতি
দূষণের কারণে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া উপজেলায় জনজীবনে নানা ধরনের ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে। উপজেলার স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা হিমেল খান প্রথম আলোকে বলেন, আখাউড়া সীমান্ত দিয়ে দূষিত ও রাসায়নিক পদার্থ মিশ্রিত পানি আসছে। এতে ডায়রিয়া, টাইফয়েড ও চর্মরোগ হওয়ার ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি। তা ছাড়া ওই পানিতে থাকা রাসায়নিকের কারণে ক্যানসারের মতো রোগ হতে পারে। তিনি বলেন, ‘আমরা বিষাক্ত মাছ ও সবজি খাচ্ছি। স্বাস্থ্যের সব ধরনের ঝুঁকি তৈরি হয়েছে।’
স্থানীয় কৃষকেরা জানান, সীমান্তবর্তী ১৫টি গ্রামে প্রায় ১ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে দূষিত পানি দিয়ে ধানের চাষ হয়। উপজেলার দক্ষিণ ইউনিয়নে ধানি জমি বেশি। মোগড়া ইউনিয়ন ও আখাউড়া পৌরসভারও কিছু জমি আছে।
উপজেলার দক্ষিণ ইউনিয়নের সাহেবনগর গ্রামের কৃষক মুসা ভূঁইয়া প্রথম আলোকে বলেন, এলাকার লোকজন জ্বর, পাতলা পায়খানা, চুলকানিসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়। কারও কারও পায়ে ঘা দেখা দিচ্ছে।
ভারত থেকে আসা কালো বিষাক্ত পানি মাছের জন্য খুব ক্ষতিকারক। এই পানিতে অক্সিজেন থাকে না, পরিমাণ প্রায় শূন্য। এই পানিতে বিষাক্ত গ্যাস ও অ্যামোনিয়া থাকে বলে মাছ বাঁচে না। উপজেলার খালগুলোতে কোনো মাছ নেই।উপজেলা মৎস্য সম্প্রসারণ কর্মকর্তা মো. রেজাউল করিম
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের আখাউড়া উপজেলা কার্যালয় থেকে জানা যায়, উপজেলায় ৪ হাজার ৭১০ হেক্টর জমিতে আমন, ৫ হাজার ৭০৫ হেক্টর জমিতে বোরো ও ২১০ হেক্টর জমিতে আউশ ধানের চাষ হয়। উপজেলায় চাষযোগ্য ৬ হাজার ৬৬৬ হেক্টর জমি রয়েছে। কৃষক পরিবারের সংখ্যা ১৬ হাজার।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. মাসুদ রানা কত একর জমি এ দূষণের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, সে তথ্য দিতে পারেননি।
মাছ চাষের জন্য আখাউড়া উপজেলা সুপরিচিত। উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, উপজেলায় বছরে ৫ হাজার টনের বেশি মাছ উৎপাদিত হয়। সেখানে ১ হাজার ৪৩০ জন মৎস্যজীবী ও ৩ হাজার ৫৫৭ জন মাছচাষি রয়েছেন।
উপজেলা মৎস্য সম্প্রসারণ কর্মকর্তা মো. রেজাউল করিম প্রথম আলোকে বলেন, ভারত থেকে আসা কালো বিষাক্ত পানি মাছের জন্য খুব ক্ষতিকারক। এই পানিতে অক্সিজেন থাকে না, পরিমাণ প্রায় শূন্য। এই পানিতে বিষাক্ত গ্যাস ও অ্যামোনিয়া থাকে বলে মাছ বাঁচে না। উপজেলার খালগুলোতে কোনো মাছ নেই।
‘কোনো সুরাহা হয়নি’
ভারত থেকে আসা দূষিত বায়ু বাংলাদেশের বায়ুদূষণের একটি বড় কারণ বলে বিভিন্ন গবেষণায় উঠে এসেছে। যদিও এই বায়ুদূষণ ঠেকানো কঠিন। তবে আগরতলায় দূষণ বন্ধ করতে পারলে বাংলাদেশে পানিদূষণ কমানো যায়।
নদী ব্যবস্থাপনা ও আন্তর্জাতিক পানি আইন বিশেষজ্ঞ ইমেরিটাস অধ্যাপক আইনুন নিশাত প্রথম আলোকে বলেন, যৌথ নদী কমিশন শুধু গঙ্গার পানি ও তিস্তার পানি নিয়ে আলোচনা করে না, দুই দেশের অভিন্ন সব নদী নিয়ে আলোচনা করে। যৌথ নদী কমিশনে বিভিন্ন পর্যায়ের সভায় দুই দেশের প্রকৌশলীরা এ বিষয়টি (দূষণের) তুলতে পারেন।
আইনুন নিশাত বলেন, আগরতলা হয়ে যে বর্জ্যটা আসে, সেখানে প্রচুর ময়লা পানি ও পলিথিন থাকে। এগুলো নিয়ে বাংলাদেশ ভারতকে বহু অভিযোগ (কমপ্লেন) করেছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো সুরাহা হয়নি।