উত্তরা গণভবনে বিচিত্র উদ্ভিদ উদ্যান

নাটোরের উত্তরা গণভবনে শতোর্ধ্ববর্ষী কর্পূরগাছ
ছবি: প্রথম আলো

‘ওই মালতীলতা দোলে, পিয়াল তরুর কোলে, পুব হাওয়াতে...’। মালতীলতা ফুল নিয়ে গান-কবিতার কমতি নেই। তবে মালতীলতা কিন্তু এখন অনেকটা দুষ্প্রাপ্য। সুখের কথা হলো, এই মালতীলতার একটি শতবর্ষী গাছ এখনো রয়েছে নাটোরের দিঘাপতিয়া রাজবাড়ি তথা উত্তরা গণভবন চত্বরে।

অসংখ্য দুষ্প্রাপ্য ফুল, ফল, তৃণলতা ও বৃক্ষরাজিতে ভরা নাটোরের উত্তরা গণভবন। উত্তরা গণভবন–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ভাষ্য, এখানে ৮০ প্রজাতির ২৫ হাজারের বেশি ফুল, ফল, তৃণলতা ও বৃক্ষরাজি রয়েছে।

দিঘাপতিয়া রাজবংশের ষষ্ঠ রাজা প্রমদানাথ রায়ের গড়া রাজবাড়িতে গড়ে তোলা হয়েছিল রাজার শখের বাগান, যা পরে ‘ইতালিয়ান গার্ডেন’ নামে পরিচিতি পায়। ১৮০২ সালে রাজবাড়িটির নির্মাণ শুরু হলেও পূর্ণতা পায় ১৯০৮ সালে। এ সময় রাজার বাগানটিতে এমন গাছপালা লাগানো হয়েছিল, যা থেকে সারা বছর ফুল-ফল ও শোভাবর্ধন হতো। প্রায় সোয়া দুই শ বছরের পুরোনো রাজার বাগানের অনেক গাছপালা এখন আর অবশিষ্ট নেই। তবে এখনো যা আছে, তা রীতিমতো দেশের অমূল্য সম্পদ হয়ে টিকে আছে। রাজা নেই, আছে রাজার শখের বাগান।

রাজার বাগানে আছে শতবর্ষী একটিমাত্র মালতীলতা। প্রাচীন কর্পূরগাছটি এখনো দাঁড়িয়ে আছে বাগানের লেকের ধারে। জনশ্রুতি আছে, গাছটির বয়স দেড় শ বছরের বেশি। এখানে আছে ২টি দুর্লভ সৌরভিকা, ২টি হোয়াইট অ্যালমন্ডা, ৭০টি শতবর্ষী রয়েল পাম বা বোটল পাম, ৪টি সাদা পয়েনচেটিয়া, গেলথোনিয়া, এগপ্ল্যান্ট, নীলমণিলতা, মেগনোলিয়া, হাইডোন্ট (জাপান), ফুরস, হাপরমালি, যষ্ঠিমধু, বনপুলক, পেয়ালি, সেঁউতি, তারাঝরা, কানাইডিংগা ও বিভিন্ন প্রজাতির সাইকাস। দুটি নাগলিঙ্গম ফুলের গাছ ছিল রাজার বাগানে। একটি মরে গেছে, অন্যটি রয়েছে প্যালেস চত্বরে।

প্রায় ২০০ বছর বয়সের দুটি পাখিফুল গাছ রয়েছে প্রবেশপথের বাঁ পাশে। এর ঘন লতাপাতা ধারণ করেছে বিশাল আকৃতি। দীর্ঘ সময় ধরে রাজবাড়ি ঘুরে দর্শনার্থীরা যখন ক্লান্ত হয়ে পড়েন, তখন তাঁরা এই দুটি গাছের ছায়ায় বসে বিশ্রাম নেন। এর লালচে ফুলের আকর্ষণ দর্শনার্থীদের মুগ্ধ করে। এর পাতার রঙেও রয়েছে বৈচিত্র্য। নতুন পাতা পূর্ণতা পেতে তিনবার রং পরিবর্তন করে। বাগানে সাতটি কুরচি বা হৈমন্তীগাছের একটি রোপণ করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, ১৯৭২ সালে।

শুধু ফুল নয়, ফলেও সেরা রাজার বাগান। দিঘাপতিয়া রাজবাড়ি চত্বরে ৬০ প্রকারের ৩০০ শতবর্ষী আমগাছ আছে। রাজা-রানি পছন্দ করে এসব গাছের মজার মজার নাম রেখে গেছেন। এর মধ্যে জালিবাঁধা, দুধসর, বেনারসি নেংড়া, বউভোলানি, জামাইভোলানি, শাহপসন্দ, রানিপসন্দ, বাবুইঝাঁপি, কলাবতী, বেলি ও ফজলি। অনেকগুলো ফজলি আমের গাছ থাকলেও রাজবাড়ির উত্তর–পূর্ব কোণের একটি গাছে দুই রকম স্বাদের আম ধরে। ২৩০টি নারকেলগাছ রয়েছে রাজবাড়ি চত্বরে। জামরুল মৃদু স্বাদের ও সহজলভ্য ফল হলেও রাজা তাঁর বাগানে লাগিয়েছিলেন একটি গোলাপজাম। এর বৈশিষ্ট্য হলো ফলটির ঘ্রাণ গোলাপ ফুল বা গোলাপজলের মতো।

শতোর্ধ্ববর্ষী সাইকাস
ছবি: প্রথম আলো

রাজার শাসনামলে লাগানো ফল গাছের মধ্যে এখনো অবশিষ্ট আছে ডেউয়া বা বনকাঁঠাল, সফেদা, কানাইডিঙ্গা (পাহাড়ি), প্রায় শত ফুট লম্বা শতবর্ষী একটি তুলাগাছ, তেজপাতা, শতবর্ষী হরীতকী, বকুল, কাঠবাদাম, চালতা ও ৭০টি কাঁঠালগাছ। কাঁঠালগাছের মধ্যে আছে বারোমাসি, বৈশাখী, রানিপসন্দ ও মৌচাক। মৌচাক কাঁঠালগাছটির বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, গাছটিতে সব সময় একটা না একটা মৌমাছির চাক থাকে। এ গাছের কাঁঠাল অনেক বেশি মিষ্টি। তবে আকৃতি ছোট হয়।

কৃষিবিদ ভবসিন্ধু রায় একসময় নাটোর হর্টিকালচার সেন্টারে উদ্যানতত্ত্ববিদ হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ২০১৯ সালজুড়ে তিনি উত্তরা গণভবনের গাছগাছালির তথ্য সংগ্রহের কাজ করেছেন। এ ব্যাপারে তিনি নানা পরামর্শসহ একটি প্রতিবেদন জেলা প্রশাসনের কাছে জমা দেন।

ভবসিন্ধু রায় প্রথম আলোকে বলেন, ‘দিঘাপতিয়া রাজবাড়ি তথা উত্তরা গণভবন চত্বরে বেশ কিছু শতবর্ষী বা তার চেয়ে বেশি বয়সের গাছ রয়েছে; যা নাটোরে তো বটেই, দেশের অন্য কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না। এগুলো আমাদের দেশের জন্য অমূল্য সম্পদ। এসব গাছ টিকিয়ে রাখতে হলে সত্বর একজন অভিজ্ঞ উদ্ভিদবিদ ও উদ্যানতত্ত্ববিদ নিয়োগ দেওয়া দরকার। যাঁরা গাছগুলো আরও বেশি দিন বাঁচিয়ে রাখতে ব্যবস্থা নিতে পারবেন।’