গাছের নাম ‘ফ্রায়েড এগ ট্রি’

কাপাসিয়ার চেওরাইদ গ্রামে ফুটেছে ফ্রায়েড এগ ট্রি ফুলছবি: লেখক

এ গাছের নামটা ভারি অদ্ভুত। গাছের এ রকম নাম শুনিনি। গাছের সঙ্গে ডিমের কী সম্পর্ক? তা–ও আবার কাঁচা ডিম না; ভাজা ডিম! রোদেলা এক দুপুরবেলায় জীবনে প্রথম সেই অদ্ভুত গাছের দর্শন পেলাম এক কবিরাজবাড়িতে। সে বাড়িতে গিয়েছিলাম একটা পারুলের চারা আনতে, সে চারার সঙ্গে বোনাস হিসেবে পেলাম এই অদ্ভুত নামের গাছটার দর্শন।

খুব সকাল সকাল ঢাকা থেকে রওনা দিয়ে কাপাসিয়ায় পৌঁছাতে বেশ বেলা হয়ে গেল। ঠিকানামতো বাস থেকে চেওরাইদ গ্রামে নেমে একজন গ্রামবাসীকে জিজ্ঞেস করলাম, কবিরাজবাড়িটা কোথায় বলতে পারেন? পাল্টা প্রশ্ন এল, ‘কোন কবিরাজবাড়ি খুঁজতাছেন? আদি কবিরাজবাড়ি?’ ধন্দে পড়লামÑআদি বা নয়া কবিরাজ, এর কোনোটাই জানি না। শুধু জানি, যে বাড়িতে যাব, তাঁর নাম সুধন দাস। নামটা বলতেই তিনি বললেন, ‘হ, উনি হইলেন গিয়া আদি কবিরাজের পুত্তুর, ওই তো রাস্তার কোলের বাড়িটা।’ বাস থেকে যেখানে নেমেছিলাম, সেখান থেকে সামান্য একটু হেঁটেই পৌঁছে গেলাম সে বাড়ি।

সত্তরোর্ধ্ব বর্ষীয়ান মানুষটা আমার জন্য অপেক্ষা করছিলেন, অথচ আমি দেরি করে ফেলেছি, লজ্জাই লাগছিল। আমাকে দেখে তিনি ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। কিন্তু তাঁকে দেখার আগেই বাড়িতে ঢুকতে ঢুকতে আমি দেখে ফেললাম থোকা ধরা বড় বড় ফলঝোলা বিরাট দুটি নাগলিঙ্গমগাছ, মটর বুটের মতো ফল ধরা জ্যামাইকান চেরি, গোলাপি ফুলের কাঠমালতী, বননীল, তীব্র সুগন্ধি সাদা রঙের পার্সিয়ান জুঁই ফুল, মাকু ফলের মতো সবুজ কোকো ফল, পারুলগাছ, নীলপুষ্পী অঞ্জন, রাজ অশোক আর অশোকগাছ। ঘরে কিছুক্ষণ বসার পর তিনি নিয়ে গেলেন অন্দরমহল পেরিয়ে বাড়ির পেছন দিকটায়। সেখানে দেখা হলো সাদা ও গোলাপি ফুলের পুনর্নভা, ব্রাহ্মী শাক, রামতুলসী, রাজতুলসী, বনতুলসী, থাই তুলসী, কৃষ্ণতুলসী, বাবুই তুলসী, শ্বেতবেড়েলা, হলুদ বেড়েলা, রক্তচিতা, পদ্ম, নীল শাপলা ইত্যাদি ঔষধি গাছের। প্রায় আট বিঘা জমির ওপর বাড়িটার ঘরদোর ছাড়া বাকি জমিটায় এ রকম নানা রকম ঔষধি গাছ লাগানো। আর সেসব গাছ সম্পর্কে তিনি জানেন ও বেশÑগাছের খোঁজখবরও রাখেন। নতুন কোনো গাছের সন্ধান পেলে তা সংগ্রহের জন্য মরিয়া হয়ে ওঠেন। পারুলের চারা দুটি তিনি সংগ্রহ করেছেন গাজীপুর শিমুলতলী থেকে। একটা রেখেছেন আমাকে দেবেন বলে।

পুরো বাড়িটার আনাচকানাচে থাকা গাছপালা দেখতে দেখতে যখন ভাবছি বসে একটু জিরিয়ে নেব, তখনই একটা গাছের তলায় সবুজ ঘাসের ওপর ঝরে পড়া একটা ফুলকে দেখে এক অদ্ভুত কৌতূহলে সেদিকে ছুটে গেলাম। ফুল তো নয়, যেন ঘাসের ওপর কেউ ভুল করে একটা ডিম পোচ করে ফেলে রেখে চলে গেছে! কাছে গিয়েই সে ভুল ভাঙল, ডিম পোচ না;Ñওটা সত্যিকার ফুল। ওপরে গাছের ডালে তাকিয়ে তো থ, বেশ কতগুলো ফুল ফুটে আছে ডালপালার আড়ালে, ডালের মাথায়। চিনি না গাছটাকে, আগে কোথাও দেখিনি। তিনি নাম বললেন, ফ্রায়েড এগ ট্রি। এ নামও শুনিনি। বললেন প্রায় চার বছর আগে তিনি গাছটি লাগিয়েছিলেন। পরের বছর থেকেই ফুল ফুটছে, ফলও হয়। এ ফুলের সঙ্গে চা–ফুল ও মাকড়ি শাল ফুলের কিছুটা মিল আছে, মিল আছে নাগেশ্বর ফুলের সঙ্গেও।

এ গাছের উদ্ভিদতাত্ত্বিক নাম Oncoba spinosa ও গোত্র স্যালিকেসি। ফ্রায়েড এগ ট্রির ইংরেজি নাম। ফ্রায়েড এগ ট্রি একটি ছোট আকারের চিরসবুজ বৃক্ষ, গাছ ২০ ফুট পর্যন্ত লম্বা হতে পারে। অরণ্যের গাছ হলেও পথতরু ও উদ্যান তরু হিসেবে এ গাছ লাগানো যায়। এ গাছের আদিভূমি দক্ষিণ এশিয়া। এ দেশে ফ্রায়েড এগ ট্রি নবাগত গাছ।

  • মৃত্যুঞ্জয় রায়, কৃষিবিদপ্রকৃতিবিষয়ক লেখক