বন–পাহাড়ের বনচালতা

টাঙ্গাইলের সখীপুরে যাদবপুর গ্রামে জ্যৈষ্ঠ মাসে ফলসহ বনচালতাগাছ
ছবি: লেখক

জ্যৈষ্ঠ মাসের দাবদাহে পুড়ছে সারা দেশ। মাঝেমধ্যে হচ্ছে দু–এক পশলা বৃষ্টি। টাঙ্গাইলের সখীপুর উপজেলার যাদবপুর গ্রামের ইট বিছানো রাস্তাটা সেই বৃষ্টিতে যাচ্ছেতাই হয়ে গেছে। গাড়ি নিয়ে যাওয়া হলো না, নামতে হলো। সে রাস্তায় সাবধানে পা ফেলে ফেলে চললাম গ্রামের ভেতরে।

তাতেই শাপেবর হলো। হঠাৎ চোখে পড়ল ফল ধরা এক বিরল গাছ। রাস্তার এক পাশে পাকা বোরো ধানের খেত, অন্য পাশে গাঁয়ের ঘরবাড়ি আর ঝোপজঙ্গল। একটা বাঁশঝাড়ের দিকে চোখ আটকে গেল হঠাৎ। প্রায় ন্যাড়া পাতাঝরা গাছের ডাল ভরে ঝুলছে লটকনের মতো প্রচুর ফল। কোনোটা সবুজ, কোনোটা হলদে, আবার কোনোটা হলদে-সবুজ। দুয়েকটা কচি পাতা গজিয়েছে। দেখতে হুবহু চালতাপাতার মতো।

আমাকে সে গাছের ছবি তুলতে দেখে হাঁটা থামিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন গ্রামের একজন। বুনো এই গাছের ছবি তুলতে দেখে তিনি হতবাক। তাঁর কাছে গাছটার নাম জানতে চাইলাম। তাঁর নামও।

নিজের নাম তিনি বললেন আবদুল গণি। গাছের নাম বললেন আজুলি। বললেন, ‘এখানে গাছ এই একটাই আছে। গ্রামে আরও দু–একটা গাছ আছে। আগে বনের মধ্যে এই গাছ বেশ দেখা যেত। এখন অনেক কমে গেছে। ঘর বানাতে আমরা এ গাছের কাঠ ব্যবহার করতাম। কাঠ খুব শক্ত। এ ছাড়া এই গাছ আর কোনো কাজে লাগে না।’

এই গাছের প্রথম দেখা পেয়েছিলাম রাঙামাটিতে। লেক পেরিয়ে রাজবন বৌদ্ধবিহার থেকে যাচ্ছিলাম চাকমা রাজার বাড়ি। রাজবাড়ির ঘাটে নেমে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠতেই চোখে পড়ল চালতাগাছের মতো বিশাল সেই গাছ। তবে গাছ–পাতার চেহারা দেখে চালতা বলে ঠিক মেনেও নিতে পারছিলাম না। পাতার অবয়ব চালতারই মতো, কিন্তু পাতা অনেক বড়। গাছে কোনো ফুল বা ফল ছিল না। অনেক উঁচু গাছ। মাথা উঠে গেছে পাশের বাঁশঝোপের সব গাছ ছাড়িয়ে।

শীতের শেষ। তাই গাছের তলায় অনেক শুকনা পাতা পড়ে ছিল। স্থানীয় এক বাসিন্দার কাছে গাছটার নাম জানতে চাইলাম। তিনি যা বললেন, তাতে নামটা বোঝাই হলো না।

ফিরে এসে বন্ধু পবন চাকমার শরণাপন্ন হলাম। তিনি গাছটির নাম বললেন ‘অগোয্যা’। চাকমাদেরই দেওয়া নাম। আমাদের ভাষায় কি এর কোনো নাম আছে? পবন আরও জানালেন, ‘চাকমারা এ গাছের হলদে ফুল সবজির মতো রান্না করে খায়। পাহাড়ের বনে–জঙ্গলে আপনা–আপনি জন্মানো এই গাছের বেশ কদর আছে। এর কাঠের দামও কম না।’

রাঙামাটির বনরূপা বাজারে ফাল্গুন মাসে বিক্রির জন্য নিয়ে আসা বনচালতা ফুল
ছবি: লেখক

পবন সত্যি সত্যি একদিন আমাকে রাঙামাটির একটি বাজারে নিয়ে গিয়ে দেখিয়ে দিল, অগোয্যা ফুল সবজির মতো বাজারে বিক্রি হচ্ছে। আমি তার ছবি নিলাম।

পরে গাছটা নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করতে করতে এর বাংলা নাম পেয়ে গেলাম। নাম বনচালতা। পেয়ে গেলাম এর আরও অনেক নাম। ইংরেজিতে গাছটির নাম ডগ টিক বা নেপালি এলিফ্যান্ট আপেল। অহমিয়া ভাষায় অকশি। চাকমাদের সঙ্গে এই নামের একটা যোগ আছে। অকশি আর অগোয্যা, কোনো একটি থেকে আরেকটি সম্ভবত রূপান্তর হয়ে এসেছে। এ গাছের আরও বেশ কয়েকটি স্থানীয় নাম পেলাম। ঢাকা-ময়মনসিংহ অঞ্চলে এর নাম আকুশি, আকশি, কারকোটা, আজুগি, আজুলি ইত্যাদি; চট্টগ্রামে হারগজা বা আরগেজা; সিলেটে একুশ। ক্ষুদ্র জনজাতির ভাষায়ও এ গাছের বিচিত্র নাম আছে।

ভারতে বিন্ধ্য পর্বতে বসবাসরত ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষের কাছে বনচালতা এক মহামূল্যবান ভেষজ বৃক্ষ। চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, ঢাকা, টাঙ্গাইল ও সিলেটের বনাঞ্চলে বনচালতাগাছ দেখা যায়।

বনচালতা আসলে চালতারই সহোদর। এর উদ্ভিদতাত্ত্বিক নাম Dillenia pentagyna। পরিবার ডিলেনিয়েসি। বনচালতা মাঝারি আকারের বৃক্ষ হলেও মাঝেমধ্যে বেশ বড় গাছও চোখে পড়ে। পাতা লম্বাটে ডিম্বাকার, কিনারা খাঁজকাটা, পাতার গোড়ার দিকটা সামান্য সরু।

এটি পাতাঝরা স্বভাবের বৃক্ষ, অর্থাৎ শীতে পাতা ঝরে যায়। পাতাবিহীন গাছে বসন্তে ও গ্রীষ্মে প্রচুর ছোট ছোট হলদে রঙের ফুল থোকা ধরে ফোটে। ফুলে সুগন্ধ আছে।

ফল উপগোলাকার। রং কমলা হলুদ। ফলের ভেতরে একটি কি দুটি বীজ থাকে। হলদে রঙের পাকা ছোট ফলগুলো দেখতে চালতার মতো।

একটা ফল নিয়ে ভেঙে দেখি, ভেতরটা নরম হলদে আমের গোলার মতো শাঁসে পূর্ণ। তার ভেতরে শক্ত বিচি। ফল খাওয়া যায় না।

  • মৃত্যুঞ্জয় রায়, কৃষিবিদপ্রকৃতিবিষয়ক লেখক