গত মাসের শেষ দিকে সাগরে লঘুচাপ সৃষ্টি হলো। চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের কুমিরাঘাট গিয়ে নিম্নচাপটির গতিবেগ ভালোভাবে বুঝতে পারলাম। ঘাট কর্তৃপক্ষ প্রায় সব ধরনের নৌযান চলাচল বন্ধ করে দিয়েছিল। এ রকম আবহাওয়ার ভেতর সন্দ্বীপ চ্যানেল পাড়ি দেওয়া একরকম অসম্ভবই বলে মনে হলো।
চ্যানেলটি পাড়ি দেওয়ার জন্য আগে থেকে ভাড়া করা স্পিডবোটের মালিকও আমাদের ঢাকায় ফিরে যেতে বললেন। উপায় না দেখে দুপুরের খাবার শেষে ঢাকায় ফিরে যাব বলে ভাবছিলাম। সেখানকার পরশমণি হোটেলে খাবার শেষ হতে না হতেই একজন নৌচালক এসে খবর দিলেন একটি মালবাহী বড় নৌকা যাবে সন্দ্বীপে। চাইলে ওই নৌকায় করে আমরাও যেতে পারি।
কোনো কিছু না বুঝেই নৌকায় উঠে পড়লাম। প্রথমবারের মতো এই চ্যানেল পাড়ি দেব। সঙ্গে আছেন প্রায় আরও ৫০ জনের মতো যাত্রী। নৌকা চলা শুরু করলে প্রথম পাঁচ মিনিটের মধ্যেই বুঝে গেলাম যাত্রাটা মনে হয় শুভ হবে না। সাগরে অনেক ঢেউ ছিল। প্রায় প্রতিটি যাত্রীর চোখেমুখে ভয়ের ছাপ। অনেকটা স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করলাম। পুরো দেড় ঘণ্টার যাত্রায় একটিমাত্র পানচিল পাখি দেখলাম। কোনো গাঙচিলের দেখা না পেয়ে অবাক হলাম। একটি ক্লান্ত প্রজাপতিকে দেখলাম নৌকার যাত্রীদের গায়ে এসে বসছে। কেউই তা খেয়াল করছে না।
সন্দ্বীপ চ্যানেলের মাঝামাঝি পথ আসার পর আরও একটি পাখিকে নৌকার গলুইয়ে এসে বসতে দেখলাম। পাখিটিও খুব ক্লান্ত। একেবারেই চেনা পাখি। নাম তার ধলা খঞ্জন। এ দেশের প্রায় সব জায়গায় দেখা যায়। তবে খঞ্জন পরিবারের সব প্রজাতিই পরিযায়ী। শীতে আমাদের অঞ্চলে আসে খাবারের আশায়। এই খঞ্জনও মনে হয় দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে এ দেশে কেবলই পৌঁছেছে। তাই তো তার নড়াচড়া কম।
সন্দ্বীপ চ্যানেল পাড়ি দিতে গিয়ে আশপাশের বেশ কয়েকজন যাত্রী অসুস্থ হয়ে পড়লেন। বেশির ভাগ মানুষই বমি করে দিয়েছেন। মূলত ‘সি-সিকনেস’ আর ভয়ের প্রভাব থেকেই এ রকমটা হয়েছে বলে মনে হলো। এ রকম অবস্থায় দেড় ঘণ্টার এই পথটাকে মনে হলো কয়েক ঘণ্টা! তবে সন্দ্বীপে নেমেই সবকিছু যেন স্বাভাবিক মনে হলো। এ রকম আবহাওয়া এ অঞ্চলের মানুষের কাছে একেবারেই স্বাভাবিক।
সন্ধ্যার আগে বেশ খানিকটা সময় আছে হাতে। গাড়িচালক মাসুদকে বললাম পুরো এলাকায় একটা চক্কর দিতে। সঙ্গে থাকা বুয়েট ছাত্র মাহফুজ মাহি বেশ ভালো পাখিপ্রেমী। সারাক্ষণ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে প্রশ্ন করছিলেন খঞ্জন নিয়ে। তাই আলোচনার বিষয় হয়ে উঠল খঞ্জন।
সন্দ্বীপ শহরের যেদিকেই যাই সেদিকেই ছোট-বড় পুকুর চোখে পড়ল। নদীপাড়টা কংক্রিটের ব্লক দিয়ে বাঁধানো। সব জায়গায় দলে বা একা একা খঞ্জনরা ঘুরে ঘুরে খাবার খাচ্ছে। চার জাতের খঞ্জনের দেখা পেলাম। যেন অচেনা এক দ্বীপে চেনা খঞ্জনের ভিড়। এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ল সিট্রিন খঞ্জন। ধলা ভ্রু খঞ্জনও দেখলাম দুটি। তবে অবাক হলাম হলদে খঞ্জনের দুটি জাত দেখে। একটির নাম পশ্চিমা হলদে খঞ্জন ও অন্যটি পূর্ব হলদে খঞ্জন। দুটি খঞ্জন দেখতে প্রায় একই রকম। কিছুদিন আগে হলদে খঞ্জনের এই প্রজাতিকে বিজ্ঞানীরা দুটি আলাদা প্রজাতিতে বিভক্ত করেছেন।
তারা ভিন্ন ভিন্ন প্রজাতির পাখি তা চেহারা দেখে বলা খুব মুশকিল। মূলত এ দুটি প্রজাতি প্রজননকাল ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় কাটায়। পূর্ব হলদে খঞ্জন প্রজননের জন্য যায় রাশিয়া, চীন ও মঙ্গোলিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে। আর পশ্চিমা হলদে খঞ্জন প্রজননকাল কাটায় পশ্চিম এশিয়া ও ইউরোপের বিভিন্ন এলাকায়। আর পরিযায়নের সময় এই দুটি প্রজাতিই বিভিন্ন সময় একই এলাকা ব্যবহার করে।
বাংলাদেশে খঞ্জন পরিবারের সাতটি প্রজাতি রয়েছে। শীতে এ দেশের প্রতিটি জলাশয়ের আশপাশে এসব প্রজাতির বিচরণ দেখা যায়। ধলা খঞ্জনের একটি বড় দলকে আমাদের ঢাকা শহরের উঁচু দালান এমনকি সংসদ ভবনের ছাদেও রাতের বেলা বিশ্রাম নিতে দেখা যায়।
শীত আসার সঙ্গে সঙ্গেই আমাদের জলাশয়গুলোর আশপাশে খঞ্জনের বিচরণ বাড়বে। লেজ নাচিয়ে নাচিয়ে আমাদের প্রকৃতিকে মুখর করে তুলবে।
সীমান্ত দীপু, বন্য প্রাণী গবেষক