আকন্দ ফুলের বর্ণিল স্মৃতি
‘আকন্দ বাসকলতা ঘেরা এক নীল মঠ—আপনার মনে
ভাঙিতেছে ধীরে ধীরে;—চারিদিকে এইসব আশ্চর্য উচ্ছ্বাস—’
—জীবনানন্দ দাশ
গ্রীষ্মের তপ্ত রোদ। নীল আকাশের নিচে কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা উপজেলার কোনো এক গ্রামের রাস্তায় হাঁটছি। একটি বেগুনি মৌটুসি পাখি উড়ে এসে বসল আকন্দঝাড়ের ডালে। পুরো আকন্দঝাড়টি তখন ফুলে আচ্ছাদিত। পিপাসার্ত পাখিটিকে দেখলাম, তার সরু ঠোঁট দিয়ে আকন্দ ফুলের মধু পান করছে। কালো রঙের ভ্রমর ফুলে ফুলে বিচরণ করছে মধুর জন্য।
যাদের শৈশব, বাল্যকাল ও কৈশোর গ্রামের পথে-প্রান্তরে, মাঠে–ঘাটে কেটেছে, তাদের কাছে আকন্দ এক মায়াবী এবং অতি চেনা বনফুল। বরিশালে আমার দুরন্ত শৈশবেও ছিল একটি আকন্দের ঝোপ। আমরা পাতা ছিঁড়ে আকন্দের সাদা কষ ঝরাতাম। ফুল ছিঁড়ে ফুলের গঠনশৈলী বোঝার চেষ্টা করতাম।
এসব করতে আমাদের সেই সময়ে খুব ভালো লাগত। আকন্দ ফুলে লেগে থাকা ভিমরুল ও ভ্রমরের গুঞ্জন আমাদের প্রতিদিন শোনা হতো। সে কথা কবি জীবনানন্দ দাশও লিখেছেন; যেমন—‘আকন্দ ফুলের কালো ভীমরুল এইখানে করে গুঞ্জরণ/রৌদ্রের দুপুর ভরে;’
এরপর অনেক বছর পেরিয়ে গেছে। তখন আমাদের পদচারণ হয়েছে দেশের আনাচেকানাচে। তখন দেখা হয়েছে কয়েক রঙের আকন্দের সঙ্গে, আকন্দ বনের সঙ্গে; কিন্তু তারপরও ছেলেবেলার আকন্দ বনটি যেন সবচেয়ে সেরা আমার কাছে! দেশের দক্ষিণাঞ্চল ও মধ্যাঞ্চলে আকন্দঝাড় বেশি চোখে পড়েছে। রংপুর বিভাগের জেলাগুলোতে আকন্দ উদ্ভিদ কম দেখেছি; তবে এ বিভাগের কিছু জেলার গ্রামে আমার খুব ভালোভাবে ভ্রমণ করা হয়নি।
আকন্দ গুল্মজাতীয় উদ্ভিদ। উদ্ভিদ সাধারণত তিন-চার মিটার পর্যন্ত উঁচু হয়ে থাকে। গাছের পাতা ছিঁড়লে কিংবা কাণ্ড ভাঙলে দুধের মতো কষ বের হয়। এ উদ্ভিদ গ্রামের কাঁচা রাস্তা, মহাসড়কের পাশে ও পতিত জমিতে দেখা যায়; কিন্তু গত দুই দশকে এ উদ্ভিদের সংখ্যা হ্রাস পেয়েছে।
মূলত জ্বালানির জন্য কাটা, পতিত জায়গায় একই ধরনের উদ্ভিদ রোপণের (মনোকালচার) করার কারণে ক্রমে উদ্ভিদটি কমে যাচ্ছে। ফুল ফোটে বসন্ত থেকে গ্রীষ্মে। তপ্ত রোদে ফুলগুলো তাজা থাকে। বাংলাদেশে প্রধানত দুই প্রজাতির আকন্দ জন্মে।
সেগুলোর মধ্যে একটি প্রজাতির Calotropis gigantean দুই রঙের ফুল হয়। সাদা ও বেগুনি-সাদা মিশেল। সাদার রঙের আকন্দ কোথাও শ্বেত আকন্দ নামে পরিচিত। আর বেগুনি রঙের ফুলের আকন্দ কোথাও লাল আকন্দ নামে পরিচিত। এ প্রজাতি দেশের অনেক জেলায় দেখেছি। অন্য প্রজাতিটির Calotropis procera ফুলের গঠন ভিন্ন এবং উদ্ভিদ ছোট। এটি ছোট আকন্দ নামে পরিচত। এ প্রজাতি কেবল পাবনা-কুষ্টিয়ায় দেখেছি।
আকন্দ গ্রামীণ মানুষের কাছে খুব প্রয়োজনীয় ভেষজ উদ্ভিদ হিসেবে পরিচিত। আকন্দ মধুপায়ী পাখি ও পোকামাকড়ের জন্য খুবই উপকারী একটি উদ্ভিদ। এ ফুলের সঙ্গে নানা প্রজাতির পতঙ্গের সম্পর্ক নিয়ে বৈজ্ঞানিক গবেষণা হতে পারে। এই উদ্ভিদের ব্যবহার্য অংশ হলো ছাল, পাতা, ফুল, মূল ও কষ। আমাদের ছেলেবেলায় ঠান্ডা লাগলে আকন্দের পাতা গরম করে ছ্যাঁকা দেওয়া হতো। কাঠপিঁপড়া কামড়ালে আকন্দ পাতার কষ লাগালে ব্যথা কমে যেত।
সৌরভ মাহমুদ, প্রকৃতিবিষয়ক লেখক