নতুন বাদুড় পেল বাংলাদেশ

বান্দরবানে দেখা পাওয়া নতুন এই বাদুড়ের নাম হিমালয়ান বড় পাতানাক বাদুড়ছবি: লেখক

বান্দরবান শহরে যখন বাস থেকে নামি, ততক্ষণে পুব আকাশে ভোরের আলো ফুটেছে। গত বছরের ডিসেম্বর মাসের ৭ তারিখ রাতে রাজারবাগ থেকে যখন বান্দরবানের বাসে উঠি, তখন বেশ অস্থির লাগছিল। অবরোধের কারণে বৃহস্পতিবার রাতে মানুষ দলে দলে ঢাকা ছাড়ছেন কক্সবাজার ভ্রমণে। অগ্রিম বুকিং ছাড়াও বহু মানুষ কাউন্টারে টিকিটের খোঁজ করছেন। বাস কাউন্টারে বসার মতো কোনো জায়গা নেই। তা ছাড়া যাত্রাপথে কোনো অসুবিধায় পড়ি কি না, তা নিয়ে ছিল উৎকণ্ঠা। শেষ পর্যন্ত কোনো ঝামেলা ছাড়াই ভোররাতে আমরা পৌঁছে যাই বান্দরবান শহরে।

হোটেলে ব্যাগ রেখে দ্রুত নাশতা সারলাম। আগে থেকে ঠিক করা একটি অটোরিকশা নিয়ে ছুটলাম বান্দরবান শহর থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরের একটি গুহায়। বাদুড়–গবেষক অংশৈ নু মারমা আগে থেকেই দেখে রেখেছেন গুহাটি। অটোরিকশা রেখে কয়েক মিনিটের হাঁটাপথ। গুহা দেখাশোনা করেন এমন কয়েকজন এগিয়ে এলেন আমাদের দেখে। আমাদের উদ্দেশ্য জানার পর একটু অবাক হলেন। পরিচয় পেয়ে গুহায় প্রবেশের অনুমতি দিলেন, সঙ্গে দিলেন একজন গাইড।

একটি সিঁড়ি বেয়ে আমরা গুহায় প্রবেশ করি। গাইড জানান, ২০১২ সাল থেকে একজন ভান্তে এখানে ধ্যান করেন। নিয়ম মেনে আমরা কিছু আগরবাতি জ্বালিয়ে জুতা রেখে গুহায় প্রবেশ করি। ভেতরটা বেশ অন্ধকার। সোলার লাইট লাগানো হয়েছে কয়েকটি। গুহার প্রবেশপথ বেশ চওড়া, প্রবেশমুখে করা হয়েছে কলাপসিবল গেট, মাঝখানে একটি প্রার্থনার ঘর। ছোট্ট ঘরটির ঠিক ওপরে ঝুলে আছে একঝাঁক বাদুড়। কালচে রং ও মাঝারি আকারের। গাইড লাইট জ্বালিয়ে দিলে বাদুড়ের ঝাঁকে একটু অস্বস্তি তৈরি হলো। এক বিশেষ ধরনের মৃদু শব্দের সঙ্গে কিছুটা নড়াচড়া শুরু করল বাদুড়গুলো।

আমরা নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে কিছু ছবি তুললাম। প্রাসঙ্গিক আলাপে বুঝলাম, বাদুড় এই গুহার অন্যতম আকর্ষণ, পুণ্যার্থীরা পবিত্র জ্ঞান করেন। ফলে বাদুড়ের নমুনা সংগ্রহ করার অনুমতি পাওয়া গেল না। অনন্যোপায় হয়ে নানা দিক থেকে বাদুড়ের বেশ কিছু ছবি নিলাম। হোটেলে ফিরে ক্যামেরার ভিউফাইন্ডারে আবারও দেখলাম ছবিগুলো। প্রাথমিকভাবে মনে হলো, এর আগে এই বাদুড় বাংলাদেশে দেখা যায়নি। বাদুড় নিয়ে সাম্প্রতিক গবেষণা ও প্রকৃতি সংরক্ষণবিষয়ক সংস্থাগুলোর আন্তর্জাতিক জোট আইইউসিএন কর্তৃক প্রকাশিত লাল তালিকাতেও এ বাদুড়ের নাম নেই।

বান্দরবান সদর ও রোয়াংছড়ি উপজেলার নানা জায়গায় ঘুরে পরের দিন ঢাকায় ফিরি। নানা রেফারেন্স ঘেঁটে বাদুড়টি বাংলাদেশের জন্য নতুন বলে মনে হলো। কিন্তু কোনো বিজ্ঞান সাময়িকীতে এটি প্রকাশ করতে হলে বাদুড়ের কিছু দৈহিক পরিমাপ প্রয়োজন। বান্দরবানের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা আবদুর রহমান সহযোগিতার হাত বাড়ালেন। পর্যবেক্ষণের পর জীবন্ত ছেড়ে দেওয়ার শর্তে কয়েক সপ্তাহ পর আমরা একটি বাদুড়ের দৈহিক পরিমাপ নিতে সক্ষম হলাম। অন্যান্য দেশের বিজ্ঞানীদের গবেষণার সঙ্গে আমাদের নমুনা তুলনা করে নিশ্চিত হলাম, এটি বাংলাদেশের জন্য একটি নতুন প্রজাতির বাদুড়। জার্মানি থেকে প্রকাশিত ম্যাম্মালিয়া নামের বিজ্ঞান সাময়িকীতে এ মাসেই এই বাদুড় নিয়ে আমাদের একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে।

এতক্ষণ যে বাদুড় নিয়ে কথা বললাম, সেটির ইংরেজি নাম ‘গ্রেটার হিমালয়ান লিফনোজ ব্যাট’। বাংলায় হিমালয়ান বড় পাতানাক বাদুড়। বাদুড়টি মাথা থেকে লেজ পর্যন্ত ৯৮ মিলিমিটার, ঊর্ধ্ববাহুর দৈর্ঘ্য ৯০ মিলিমিটার এবং লেজ প্রায় ৫০ মিলিমিটার। মুখের দুই পাশে চার জোড়া করে সংযুক্ত লিফলেট দেখে অন্য বাদুড়ের জাত থেকে এটি আলাদা করা যায়।

হিমালয়ান বড় পাতানাক বাদুড় ভারতের আসাম, মিজোরাম ও পশ্চিমবঙ্গে দেখা গেছে। এ ছাড়া মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়ায় এই বাদুড় নথিভুক্ত হয়েছে। বিরল প্রজাতির হওয়ায় এ বাদুড় সম্পর্কে খুব বেশি তথ্য বিজ্ঞানীদের হাতে নেই। আমাদের এ গবেষণার মাধ্যমে বাংলাদেশের স্তন্যপায়ী প্রাণীর তালিকায় যোগ হলো একটি নতুন প্রজাতির বাদুড়।

  • এম এ আজিজ, অধ্যাপক, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়