সোনাদিয়ায় কালো-পা গঙ্গাকৈতর

চরে দাঁড়ানো কালো-পা গঙ্গাকৈতর। ৮ মার্চ কক্সবাজারের সোনাদিয়ায়ছবি: লেখক

সারা রাত বাস ভ্রমণ শেষে ঘুম ঘুম চোখে ভোরবেলা কক্সবাজার বাস টার্মিনালে নামলাম। পাশেই একটি রেস্তোরাঁয় হাত-মুখ ধুয়ে নাশতা সারলাম। বার্ডিংবিডি ট্যুরসের পক্ষী আলোকচিত্রী ইকবাল বাবু দুপুরের জন্য শুকনো খাবার ও পানি নিয়ে আসতেই দ্রুত অটোতে চাপলাম। মিনিট বিশেকের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম কক্সবাজার এয়ারপোর্টসংলগ্ন মহেশখালীর গুদারাঘাটে।

কিন্তু ঘাটে গিয়েই মনটা খারাপ হয়ে গেল। বারবার ফোন করেও নুর আলম মাঝিকে পাওয়া গেল না। এদিক-সেদিক খোঁজ নিয়ে জানা গেল, ভুল করে বা অজানা কারণে আমাদের টিম ভেবে আরেকটি টিমকে নিয়ে তিনি সোনাদিয়া চলে গেছেন। ঘাটে মাঝির অভাব নেই; পরিচিত একজন যেতেও চাইল।

কিন্তু যাকে-তাকে নিয়ে তো আর সোনাদিয়া যাওয়া যায় না। শেষ পর্যন্ত ঢাকা থেকে বার্ডিংবিডি ট্যুরসের টিম লিডার জাবের আনসারী নুরুলের সঙ্গে যোগাযোগ করলে ওর ভাগনে রাশেদকে পাঠাল। আর এসব কারণে সোনাদিয়া পৌঁছাতে ঘণ্টাখানেক দেরি হয়ে গেল।

ঘড়ির কাঁটায় ৯টা ৩৮ বাজতেই সোনাদিয়ার বেলেকেরদিয়ায় পৌঁছালাম। জোয়ার এসে গেছে, চরের বেশির ভাগ জায়গা ডুবে গেছে। স্পিডবোট থেকে নামার আগমুহূর্তে বাইনোকুলারে চোখ রেখেই আমার স্বপ্নের গঙ্গাকৈতরের দেখা পেয়ে গেলাম। দ্রুত নেমে একটি সাক্ষী ছবি তুললাম। মনটা আনন্দে ভরে উঠল। স্পিডবোট নিয়ে সকালের অস্বস্তিকর ঘটনার কথা ভুলে গেলাম। জোয়ারের পানিতে পুরোপুরি ডুবে যাওয়ার আগপর্যন্ত পাখিগুলোর ছবি ও ভিডিও চিত্র ধারণ করে কালাদিয়া চরের উদ্দেশ্যে স্পিডবোট ছাড়লাম।

এতক্ষণ আমার স্বপ্নের যে পাখিটির গল্প বললাম, তা এ দেশের অতি বিরল ও তথ্য অপ্রতুল অনিয়মিত পরিযায়ী পাখি ব্ল্যাক-লেগড কিটিওয়েক। কোনো বাংলা নাম নেই। ওর ডাক ‘কিট-টি-ওয়া-আক’ থেকে ইংরেজি নামের উদ্ভব। ল্যারিডি গোত্রের পাখিটির বৈজ্ঞানিক নাম Rissa tridactyla, যার অর্থ ‘তিন-আঙুলে গঙ্গাকৈতর’। কাজেই ওকে বাংলায় ‘কালো-পা গঙ্গাকৈতর’ বলা যায়। ভবঘুরে পাখিটিকে ২০১৫ সালের ৪ জানুয়ারি ভোলা জেলার তুলতুলি এলাকায় মেঘনা নদীতে উড়ন্ত অবস্থায় প্রথমবার দেখেছিলেন পক্ষীবিদ আব্দুল মজিদ শাহ শাকিল। এরপর গত দুই বছর জ্যান-এরিক নিলসেন নামে একজন বিদেশি পাখি পর্যবেক্ষক সোনাদিয়ায় একটি কম বয়সী পাখি দেখেন। এবার ছোট-বড় চারটি পাখি এসেছে। পাখিটির মূল আবাস উত্তর আটলান্টিক ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকা অর্থাৎ উত্তর আমেরিকা, নরওয়ে, রাশিয়া, আলাস্কা, জাপান, কোরিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জ।

এটি ছোট, কমনীয় ও তিন-আঙুলের খাটো পা–ওয়ালা গঙ্গাকৈতর। দেহের দৈর্ঘ্য ৩৭ থেকে ৪১ সেন্টিমিটার ও ওজন ৩০৫ থেকে ৫২৫ গ্রাম। প্রাপ্তবয়স্ক পাখির মাথাসহ দেহের নিচটা সাদা। দেহের উপরিভাগ ও ডানা নীলচে–ধূসর; ডানার অগ্রভাগ কালো। লেজ কিছুটা চেরা, চঞ্চু হলদে ও মুখের ভেতরটা কমলা-লাল। স্ত্রী-পুরুষ একই রকম হলেও স্ত্রী আকারে ছোট। প্রজননকালীন পাখির চোখের চারদিকে সরু লাল বলয় থাকে। অন্যদিকে প্রজননহীন পাখির মাথা ও ঘাড়ে ধূসর-কালো দাগছোপ ও চোখের পেছনে গাঢ় দাগ থাকে। অপ্রাপ্তবয়স্ক পাখির ডানার দৈর্ঘ্য বরাবর আঁকাবাঁকা কালো দাগছোপ, কালো গলাবন্ধ, ঘাড় ও চোখের পেছনে গাঢ় ছোপ থাকে। লেজের আগা কালো। চঞ্চু কালো, যা বয়সের সঙ্গে সবুজ হয়ে প্রাপ্তবয়স্ক পাখিতে গাঢ় হলুদ হয়।

এরা সামুদ্রিক পাখি। শীতে পটুয়াখালী ও সোনাদিয়ায় দেখা গেছে। একক বা অন্যান্য গঙ্গাকৈতর, গাঙচিল ও জলচর পাখির মিশ্র দলে বিচরণ করে। প্রধান খাদ্য সামুদ্রিক মাছ হলেও স্কুইড, চিংড়ি ও অন্যান্য জলজ অমেরুদণ্ডী প্রাণীও খায়। অন্য পাখির খাবার চুরি বা খাবারে ভাগ বসাতে ওস্তাদ। বেশ কমনীয়ভাবে ওড়ে। লম্বা টানে ‘কিট-টি-ওয়া-আক’ শব্দে ডাকে। তবে খাবার সময় ছোট্ট করে ‘কোয়ার্ক’ বা ‘কেওয়াক’ শব্দে ডাকে।

জুন থেকে আগস্ট প্রজননকাল। এ সময় সমুদ্র উপকূলে বিশাল উপনিবেশ গড়ে একসঙ্গে হাজার হাজার, এমনকি লক্ষাধিক পাখি বাস করে। উপকূলীয় পাহাড়ের চূড়ায় উপনিবেশ বাসা তৈরি করে এক থেকে তিনটি ডিম পাড়ে। ধূসর বা বাদামি রঙের ডিমে বাদামি ছিটছোপ থাকে। বাসা বানানো, ডিমে তা দেওয়া ও ছানাগুলোর লালন-পালন মা–বাবা মিলেমিশে করে। গড়ে ২৫ দিনে ডিম ফোটে। ছানাগুলো ৩৪ থেকে ৫৮ দিনে উড়তে শেখে। এরপরও কয়েক সপ্তাহ মা–বাবার সঙ্গে থাকে ও অবশেষে সমুদ্রে পাড়ি জমায়। প্রাপ্তবয়স্ক হতে কমবেশি চার বছর লাগে। আয়ুষ্কাল প্রায় ১৩ বছর।

  • আ ন ম আমিনুর রহমান, পাখি ও বন্য প্রাণী প্রজনন ও চিকিৎসাবিশেষজ্ঞ