পাহাড়ি বনের মর্মর বিড়াল

সংগ্রহশালায় বাংলাদেশে মর্মর বিড়ালের একমাত্র জীবিত নমুনাছবি: মনিরুল এইচ খান

২০১৩ সালের মার্চ মাস। শ্রীমঙ্গলের দক্ষিণে সীমানা লাগোয়া এক খাসিয়া গ্রাম। অল্প দূরেই এককালের চিরসবুজ বনের ধ্বংসাবশেষ। একদিন সেখানে গ্রামের পাহারাদার সারমেয় বাহিনীর নজরে পড়ে গেল দুটি বিড়াল। ধাওয়া খেয়ে মা বিড়ালটি পালাতে পারলেও ছানাটি ধরা পড়ে যায়। গাঢ় হলুদাভ খয়েরি গায়ে অসংখ্য দাগ, সঙ্গে কালো ছোপ ছোপ। এ রকম কেউ দেখেনি আগে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মনিরুল এইচ খান ছানাটি সঠিকভাবে শনাক্ত করলেন। মর্মর বিড়াল। বাংলাদেশের প্রথম নমুনা। প্রাণিবিদ্যায় অনার্স সদ্য শেষ করেছি তখন। আইইউসিএন ক্যাট স্পেশালিস্ট গ্রুপের জার্নালে প্রকাশিত অধ্যাপক খানের লেখা প্রবন্ধটি মনে ভীষণভাবে দাগ কাটল। তার আগে পর্যন্ত যে শিখে এসেছি এ দেশে মর্মর বিড়াল বিলুপ্ত!

মর্মর মানে মার্বেল। এ বিড়ালের পায়ে কালো ছোপ ছোপ দাগ। পাশে, পিঠে আর মাথায় ছোপগুলো ক্রমে বড় হতে হতে সাদা-কালো নকশা তৈরি করে। একদম মার্বেল পাথরে দেখা শিলাবিন্যাসের মতো। ইংরেজি নাম তাই মারবেলড ক্যাট, বৈজ্ঞানিক নামেও আছে এর উল্লেখ (পারডোফেলিস মারমোরাটা)। মর্মর বিড়াল; কিন্তু আকারে বেশি বড় নয়, পোষা বিড়াল থেকে সামান্য। মাথা থেকে লেজের গোড়া পর্যন্ত মাত্র ৪৫ থেকে ৬২ সেন্টিমিটার। তবে লেজ প্রায় শরীরের সমান লম্বা, ৫৫ সেন্টিমিটার পর্যন্ত হতে পারে, বেশ লোমশ আর অত্যন্ত শক্তিশালী। ছোট শরীরে বড় লেজের কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে। এ বিড়াল গাছে উঠতে অত্যন্ত পারদর্শী। এশীয় বিড়ালের মধে৵ একমাত্র প্রজাতি, যেগুলো গাছ থেকে নামার সময় মাথা নিচের দিকেও রাখতে পারে।

মর্মর বিড়াল দিবাচর। পোকা, ছোট পাখি, গিরগিটি, কাঠবিড়ালি প্রভৃতি খেয়ে থাকে। তবে গেছো স্বভাবের কারণে এর দেখা মেলা ভার। ক্যামেরা ট্র্যাপ–পদ্ধতি অবলম্বন করেও সুবিধা তেমন পাওয়া যায় না। গাছে উঠে ক্যামেরা বসানো অত্যন্ত শ্রমসাধ্য। আর এ বিড়াল মাটিতে ঘোরাফেরা করে খুব কম। ২০১৩ সালের পর ক্রিয়েটিভ কনজারভেশন অ্যালায়েন্সের ক্যামেরা ট্রাপে সাঙ্গু-মাতামুহুরীর বন থেকে বাংলাদেশে মর্মর বিড়ালের দ্বিতীয় কিন্তু বুনো পরিবেশে প্রথম নিদর্শন পাওয়া যায়।

মর্মর বিড়ালের নিবাস হিমালয়ের পাদদেশের মিশ্র চিরসবুজ বন থেকে শুরু করে সিলেট-চট্রগ্রামের পাহাড়ি বন পেরিয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, সুমাত্রা ও বোর্নিওর চিরসবুজ বন। বোর্নিওতে রেডিও-কলার গবেষণায় দেখা গেছে, একটি মর্মর বিড়াল প্রায় ছয় বর্গ কিলোমিটারজুড়ে ঘোরাফেরা করে। এ বছর প্রকাশিত অস্ট্রেলীয় গবেষকদের এক প্রবন্ধ অনুসারে বড় গাছের ঘন বনের সঙ্গে পাহাড়, গিরিখাত আছে, এমন জায়গাতেই এই বিড়াল বাস করে। পাহাড়-পর্বত অনুরাগী অনেকেরই হাতেখড়ি দুর্গম সীতাকুণ্ডের বন। তবে কি এ বনে মর্মর বিড়াল আছে?

অনুমান সত্যি হলো শিগগিরই। সীতাকুণ্ডের দক্ষিণ প্রান্ত কেটে বানানো বায়েজিদের রাস্তায় ২০২৩–এর শুরুতে গাড়ি দুর্ঘটনায় পড়ে থাকল এক হতভাগা। অনেক গবেষক বললেন, এটি হয়তো কোনো খাঁচা থেকে পালিয়েছে। তবে এর কিছুদিন পরেই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-উপাচার্য ও প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মোস্তফা ফিরোজ ও অধ্যাপক ড. কামরুল হাসানের ক্যামেরা-ট্রাপ গবেষণায় পাওয়া গেল আরেকটি বিড়াল, সীতাকুণ্ড রেঞ্জেরই আরেক প্রান্ত থেকে। বাংলাদেশে ঘন পাহাড়ি বনের দিন ভালো যাচ্ছে না। মর্মর বিড়াল বিশ্বব্যাপী বিপদাপন্ন।

এ বিড়াল নিয়ে আমার গত চার বছরের অপেক্ষার অবসান ঘটাল কাসালং বন। বন বিভাগের সহায়তায় রাঙামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বন ও পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. সুপ্রিয় চাকমার সঙ্গে যৌথভাবে একটি ক্যামেরা ট্র্যাপ গবেষণা করছি। এ বছর বর্ষার ঠিক আগে এক ক্যামেরায় পাওয়া গেল এর ছবি। বিস্ময়কর হলো—ঠিক যে সকালে এই লেখার খসড়া তৈরি করি, সেই সন্ধ্যায় ছবিটি শনাক্ত করি। ঘনবসতির বাংলাদেশে ক্ষুদ্র উদ্দেশ্য আর ভুল পদক্ষেপে ক্রমে ছোট হয়ে আসা বনগুলো এসব বিস্ময় জোগাক আরও শত বছর। আমরা যেন বিশ্বাস হারিয়ে না ফেলি।

  • মুনতাসির আকাশ, সহকারী অধ্যাপক, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়