‘চোখ গেল পাখি রে...’

বীজতলার জালে আটকা পড়া সেই বাচ্চা চোখ গেল পাখি
ছবি: রেদওয়ানুল ইসলাম

পাখির ছানাটি সদ্য বাসা ছেড়েছিল, পালক মা-বাবার পেছনে উড়ে-ঘুরে আর দুই পাখা প্রচণ্ড ঝাঁপিয়ে-ঝাঁকিয়ে ‘আরও খাব, আরও খাব’ বলে একটানা ডেকেই চলেছিল, জোরে জোরে গাল হাঁ করে হাভাতের মতো (নাকি হা–শুঁয়াপোকা, হা-পোকামাকড়)। পালক মা-বাবার প্রাণান্ত দশা করে ফেলেছিল।

হয়তো পালক মা-বাবার পেছনে ঘুরতে ঘুরতেই বাগানের নিচের আমন ধানের বীজতলার কাছের ঝোপঝাড়ে এসে বসেছিল ছানাটি; বীজতলাটি ঢেকে রাখা ছিল নাইলনের জাল দিয়ে। তখন যেভাবেই হোক ছানাটি মশারির জালে আষ্টেপৃষ্ঠে আটকা পড়ে দাপাদাপি, ডাকাডাকি ও ছটফট করতে থাকে।

বীজতলাটি গ্রামের আজিজ সর্দারের। তিনি এসে পেলেন পাখিটি। সাবধানে জালমুক্ত করে বাড়িতে এনে খবর দেন গ্রামের শেখ জসীমকে। জসীম ঢাকা বন্য প্রাণী অপরাধ দমন ইউনিটের সদস্য। ঘটনার দিনটিতে (গত ১৫ মে) তিনি ছুটিতে বাড়িতেই ছিলেন। স্থান সাতক্ষীরা জেলার তালা সদর ইউনিয়নের আগোলঝাড়া গ্রাম।

স্থানীয় ওয়াইল্ডলাইফ মিশনের রাশেদ বিশ্বাসকে সঙ্গে নিয়ে আনাড়ি ও খাই খাই স্বভাবের ছানাটিকে তিনি শনাক্ত করেন। জসীম ফোন করে আমার পরামর্শ চান। ছানাটির পাখা ও পাখার পালক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। ঝরেও পড়েছিল দু–একটি পালক। জসীম ছানাটিকে ঘরোয় চিকিৎসা দেন। ওটিকে খেতেও দেন শুঁয়াপোকা ও ঘাসফড়িং। পানি ছিটিয়ে গোসল করিয়ে ঘরের চালার ওপরে তিনি রেখে দেন।

রাশেদ, জসীমসহ আজিজ সর্দারের কথাবার্তায় নিশ্চিত হওয়া গেল, ছানাটির জন্ম বীজতলার পাশের বাগানের একটি গাছের হলদে বউ পাখির বাসায়।Ñআজিজ সর্দার দুদিন আগেই দেখেছিলেন ছানাটিকে—দুটি হলদে বউ পাখি সমানে খাইয়ে যাচ্ছে। যাহোক, কথা বলতে বলতেই ছানাটি হঠাৎ ঘরের চালা থেকে উড়াল দিয়ে দূরে গেল দ্রুতগতিতে।

বীজতলার জালে আটকা পাখিটির নাম ছন্দোবদ্ধ কবিতার মতো সুন্দর—‘চোখ গেল’। এ পাখি নিয়ে ছড়া, কবিতা, গান ও গল্প আছে অনেক। আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছেন, ‘চোখ গেল পাখি রে...।’ শুধু হলদে বউ নয়;Ñএ পাখি ডিম পাড়ে কমলা বউ, ছাতারে, মেঠোছাতারে, শালিক, কসাই ইত্যাদি পাখির বাসায়। সহজে কি আর ডিম পাড়া যায় পরের বাসায়! কৌশল লাগে। কৌশলটা কী? দুটি পাখি বাসার দুদিকে অবস্থান নেয় সাবধানে।

পুরুষটি উড়ে বাসার কাছাকাছি যায়। বাসার পাখি দুটির তখন চোখ গেল পাখির মতলব বুঝে মাথা খারাপ হয়ে যায়।Ñকরে ধাওয়া। ওই সুযোগে স্ত্রী পাখিটি এসে ডিম পেড়ে যায়। এক বাসায় নয়, বিভিন্ন বাসায় মোট পাঁচ-ছয়টি ডিম পাড়ে। শুধু চোখ গেল নয়, জাতভাই কোকিল, পাপিয়া, বউ কথা কও পাখিও অন্য পাখির বাসায় ডিম পাড়ে। পোষক পাখি পরের ডিমে তা দিয়ে ছানা ফুটিয়ে খাইয়েদাইয়ে বড় করে তোলে। পোষক পাখির চোখে এ সময় প্রকৃতি ঘোলাটে গোলকধাঁধাময় চশমা পরিয়ে দেয়, কিছু বোঝে না ওই বোকারা!

ঢাকা শহরসহ সারা দেশে দেখতে পাওয়া চোখ গেল পাখির ইংরেজি নাম Common hawk-cuckoo, বৈজ্ঞানিক নাম Hierococcyx varius. দৈর্ঘ ৩৪ সেন্টিমিটার, ওজন ১০০ গ্রাম। মূল খাদ্য শুঁয়াপাকা, বিভিন্ন পোকামাকড়, ফল, গিরগিটি ইত্যাদি। ‘চোখ গেল, চোখ গেল’ সুরে এ পাখি জোরে জোরে একটানা ডাকতেই থাকে। মানুষের কান-মাথা ঝিমঝিম করে, তাই বোধহয় এ পাখির আরেক নাম Brain fever Bird।

শরীফ খান, পাখি ও বন্য প্রাণিবিষয়ক লেখক