মাদারীপুরের ক্যাকটাস ভুবনে

মাদারীপুরে দেখা চকলেট ক্যাকটাসছবি: লেখক

একটা ক্যাকটাস দেখে মনে হলো কেউ বুঝি গোশত কেটে টুকরা করে রেখেছে। অদ্ভুত চেহারা, কোনোভাবেই তাকে গাছ বলে মনে হচ্ছে না। নাম চকলেট ক্যাকটাস, তাই চেহারাটাকে গলে যাওয়া চকলেট ভাবলেও ভুল হবে না। এটা বেশ বড় গাদা করে জন্মে, অন্য ক্যাকটাসের মতো শক্ত নয়, কাণ্ডের অগ্রপ্রান্ত বা কিনারা খাঁজকাটা ও কোঁচকানো, সূক্ষ্ম²পশমের মতো কাঁটাও থাকে সেসব খাঁজের মাথায়। অন্য প্রজাতির ক্যাকটাসের কাণ্ডের মাথায় এই ক্যাকটাসের অংশজুড়ে তৈরি করা হয়েছে চকলেট ক্যাকটাসগাছ।

মাদারীপুর হর্টিকালচার সেন্টারে গিয়ে সম্প্রতি দেখা হলো বিচিত্র সব ক্যাকটাস।

একটি ক্যাকটাসের চ্যাপটা পুরু সবুজ পাতার মধ্যে দেখলাম খুদে খুদে ফোড়ার মতো হালকা উঁচু উঁচু গড়ন। অনেক শাখা–প্রশাখা নিয়ে গাছটা হাত দেড়েক লম্বা হয়েছে। এ রকম গাছ আমাদের গ্রামের অনেক জায়গায় চোখে পড়ে, কেউ কেউ বাড়ির বেড়া হিসেবে লাগায়, পদ্মের মতো পাপড়ি মেলে ফুল ফোটে। এ জন্য অনেক গাঁয়ে এ ক্যাকটাসকে বলে পদ্মসেজী, উদ্ভিদবিদেরা বলেন ওপানশিয়া, বাংলা নাম ফণীমনসা। আর একটা ক্যাকটাসের খেজুরগাছের মতো দেহে থাকে খাঁজকাটা, ডালপালার মতো অঙ্গ, মাঝের প্রধান কাণ্ডটির মাথায় কয়েকটি ম্যাজেন্টা রঙের ফুল। এটি একধরনের ইউফরবিয়া, উদ্ভিদতাত্ত্বিক নাম ইউফরবিয়া টুলিয়রেনসিস।

কোনো কোনো ক্যাকটাসের গায়ে কাঁটাভর্তি, কোনোটার গায়ে কাঁটা নেই, আছে চিত্র–বিচিত্র নকশা। কোনোটার কাঁটাগুলো আবার কোমল, কোনোটার কাঁটা খুবই তীক্ষ্ণ ও শক্ত। কোনোটার রং সবুজ, কোনোটার রং লাল, কোনোটার আবার নীল। নীল রঙের চ্যাপটা গোলাকার একটি ক্যাকটাস চোখে পড়ল, কাঁটা দেখলাম না তাতে, ইংরেজি নাম ডিভাইন ক্যাকটাস, উদ্ভিদতাত্ত্বিক নাম লোফোপোরা উইলিয়ামসি। কাঁটাবিহীন এই ক্যাকটাসের মাথা গভীরভাবে পাঁচটি খাদে বিভক্ত, কেন্দ্রে একটা হালকা গোলাপি রঙের ফুল ফোটে গরমকালে। ডিভাইন ক্যাকটাসের জন্ম মেক্সিকোয়।

ডিভাইন ক্যাকটাস
ছবি: লেখক

নীলচে সবুজ রঙের আরেকটি ক্যাকটাসের দেখা মিলল সেখানে, গড়ন অনেকটা গির্জার পাদরিদের মাথার মুকুটের মতো। এ জন্য এর ইংরেজি নাম রাখা হয়েছে বিশপ’স ক্যাপ ক্যাকটাস, উদ্ভিদতাত্ত্বিক নাম অ্যাস্ট্রেফাইটাম মিরিওস্টিগমা। সে ক্যাকটাসের মাথায় দুটো হলদে ফুল ফুটে আছে তারার মতো।

একে একে সেখানে ক্যাকটাস হাউসের মধ্যে দেখা হলো অ্যাস্ট্রোফাইটাম, স্টেপেলিয়া, ম্যামিলারিয়া, জিমনোক্যাকটাস, ফেরো ক্যাকটাস, হেমাটো ক্যাকটাস, গোল্ডেন ব্যারেল, লাভাভিয়া, ব্রেইন ক্যাকটাস, কোরাল ক্যাকটাস, চকলেট ক্যাকটাস, রেইনবো ক্যাকটাস, ইউফরবিয়া, ওল্ড লেডি, ওল্ড ম্যান, বানানা ক্যাকটাস, নোটো ক্যাকটাস, পিনাট ক্যাকটাস, প্যারোডিয়া, ইচিনোপসিস, ক্রিস্টেড, লেডি ফিঙ্গার, র‌্যাটস টেইল ক্যাকটাস, মাংকিটেইল ক্যাকটাস, ক্যাটস টেইল ক্যাকটাস, ফেইরি ক্যাসেল, বান্নি ক্যাকটাস, ওপানশিয়া বা ফণীমনসা ইত্যাদিসহ প্রায় ২০০ প্রজাতির ক্যাকটাস।

মাদারীপুর হর্টিকালচার সেন্টারের উপপরিচালক কৃষিবিদ আশুতোষ কুমার বিশ্বাস আমাদের ঘুরে ঘুরে এসব ক্যাকটাস দেখাচ্ছিলেন। আর সেসব ক্যাকটাস সম্পর্কে কথা বলছিলেন। দেশের নানা জায়গা থেকে তিনি ব্যক্তিগত আগ্রহে সংগ্রহ করেছেন এসব ক্যাকটাস। সেসব ক্যাকটাসের অনেকগুলোতেই ফুল ফুটছে। তিনি বলেন, ফুলের পর ফল হবে, ফলের ভেতর বীজ হবে। অনেক ফলের বীজ থেকে তিনি প্রচুর চারা তৈরি করে বিক্রি করেন। এ ছাড়া জোড় কলম করে জিমনো ক্যাকটাসের মতো অনেক ক্যাকটাস তৈরি করেন। কুঁড়ি থেকেও চারা হয়, এমনকি কোনো কোনো ক্যাকটাসের কাণ্ডকেটে লাগালেও চারা হয়। ক্যাকটাস খুব চমৎকার বৈচিত্র্যময় চেহারার সপুষ্পক উদ্ভিদ। উদ্ভিদপ্রেমীরা খুব অল্প যত্নেই ক্যাকটাস লালন–পালন করে ঘর সাজাতে পারেন, জায়গাও লাগে অল্প।

আশুতোষ কুমার বিশ্বাস জানালেন, পৃথিবীতে বর্তমানে ১৩৯টি গণের প্রায় দুই হাজার প্রজাতির ক্যাকটাস আছে। তাঁর ধারণা, বাংলাদেশে প্রায় ৪০০টি প্রজাতির ক্যাকটাস বিভিন্ন সংগ্রাহকদের কাছে আছে। এর মধ্যে তাঁর সংগ্রহে রয়েছে প্রায় ২০০টি প্রজাতির ক্যাকটাস। বিগত দশকেই এ দেশে ক্যাকটাসের আগমন সবচেয়ে বেশি ঘটেছে। নিত্যনতুন প্রজাতির আগমন অব্যাহত রয়েছে। কষ্ট সইতে পারা গাছ উদ্ভিদজগতে খুব কমই আছে। সহজে চাষ করা যায় বলে এর জনপ্রিয়তা দিন দিন বাড়ছে। আমরা যে ড্রাগন ফল খাই, সেটাও একধরনের ক্যাকটাস।

ক্যাকটাস দেখা শেষ হলে পাখিবিদ ইনাম আল হক শোনালেন প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপে গ্যালাপোগাসে তাঁর দেখা ক্যাকটাসগুলোর কথা আর ক্যাকটাস খেয়ে যারা বাঁচে, সেসব প্রাণীর কথা। তিনি সেসব জায়গায় তিন বেলা ক্যাকটাস খেয়ে কীভাবে ৯ দিন বেঁচে ছিলেন, সেসব কথাও জানা হলো। বাংলাদেশ কাউন্সিল ফর নেচার কনজারভেশনের আয়োজনে সারা দিন ধরে ক্যাকটাসপ্রেমী ২৭ জনের দলটি সেই বিস্ময়ভরা ক্যাকটাস–কথা শুনে আর দেখে শেষে ফিরে চলল ঢাকার পথে।

  • মৃত্যুঞ্জয় রায়, কৃষিবিদ প্রকৃতিবিষয়ক লেখক