আবার বনে ফিরবে পাঁচ উদ্ভিদ

মহাবিপন্ন বন খেজুর দেখা যায় শুধু দিনাজপুরের বিরল উপজেলার ধর্মপুর শালবনেই। তা–ও আবার সংখ্যায় ২০০–এর নিচেছবি: সায়েদুর রহমান

সুন্দরবনের সুপতি আর হরিণটানা খাল। বহুবার গিয়েছি বুনো প্রাণীর খোঁজে। বেশির ভাগ সময়ই গবেষণাকাজে। কিন্তু গত বছরের শেষ ভাগে গেলাম দুটি পরাশ্রয়ী উদ্ভিদের খোঁজে। উদ্ভিদ নিয়ে জানাশোনা না থাকলে এদের খুঁজে পাওয়া প্রায় অসম্ভব। সেই যাত্রায় গাছগুলোর হদিস মিলল না।

উদ্ভিদবিজ্ঞানী অধ্যপক গাজী মোশারফ হোসেনের নেতৃত্বে গত ১৭ এপ্রিল আবার একদল গবেষক গেলেন সুন্দরবনে। দেখা মিলল দুটি উদ্ভিদের। এই অর্কিড দুটির নাম ছোট বাল্ব অর্কিড ও বাল্বোরক্স। ছোট বাল্ব অর্কিডের দেখা মেলে এখন শুধু সুন্দরবনের সুপতি ও হরিণটানা খালে। এই খাল দুটি ছাড়া সুন্দরবনের অন্য এলাকায় এদের দেখা মেলে না। আর বাংলাদেশের অন্য এলাকাতেও এই অর্কিডের অস্তিত্ব টিকে নেই। আর বাল্বোরক্স অর্কিড টিকে আছে চাঁদপাই ও শরণখোলা এলাকার কয়েকটি খালে। সংখ্যায় একেবারে সীমিত। সম্প্রতি আইইউসিএন বাংলাদেশ উদ্ভিদের যে লাল তালিকা প্রকাশ করেছে, সেখানে এই দুটি অর্কিডকে মহাবিপন্ন হিসেবে উল্লেখ করা
হয়েছে। সংরক্ষণের উদ্যোগ গ্রহণ না করলে এরা আমাদের বন থেকে অচিরেই হারিয়ে যেতে পারে।

এই অর্কিড দুটি ছাড়া আরও তিনটি মহাবিপন্ন বৃক্ষ প্রজাতি আছে আমাদের দেশে। এর একটির নাম বন খেজুর। খেজুরগাছের একটি প্রজাতি এটি। গাছটির খোঁজে আমরা মে মাসের ১২ তারিখ গিয়েছিলাম দিনাজপুর। এ জেলার বিরল উপজেলার ধর্মপুর শালবনেই শুধু এই খেজুরগাছ টিকে আছে। তা–ও আবার সংখ্যায় ২০০–এর নিচে। ছোট আকারের গাছটি পামজাতীয় উদ্ভিদের মতো। ফুলের টবে জন্মানোর মতো গাছ এটি। এটি বীজের মাধ্যমে বংশবৃদ্ধি করে। আমরা যে খেজুরগাছ সাধারণত দেখি, সে রকম খেজুরগাছ এটি নয়। মাটির কাছাকাছি এরা ফল দেয়। কাঁচা খেজুর লাল বর্ণের আর পাকলে তার ফল কালো হয়ে যায়। কাঁচা ফলের শাঁস পাতলা হলেও অত্যন্ত মিষ্টি।

ছোট বাল্ব অর্কিড (ট্রায়াস অবলংগা), এখন টিকে আছে শুধু সুন্দরবনের হরিণটানা আর সুপতি খালে
ছবি: সুলতান আহমেদ

অন্য দুটি মহাবিপন্ন উদ্ভিদের নাম হলো চালমুগড়া ও বাঁশপাতা। চালমুগড়া বৃক্ষটি এ দেশের বান্দরবান, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও রাঙামাটির বনে একসময় দেখা যেত। এখন বিরল হয়ে গেছে। এ উদ্ভিদ বীজের মাধ্যমে বংশ বৃদ্ধি করে। তবে সমস্যা হলো, এর বীজ উচ্চ ও স্বল্প তাপমাত্রা—কোনোটিই সহ্য করতে পারে না। সবশেষ উদ্ভিদটির নাম বাঁশপাতা। গাছটি বাণিজ্যিকভাবে একসময় ব্যাপক ব্যবহার হতো মূলত পেনসিল তৈরির কাজে। দেশের বিভিন্ন বনাঞ্চলে গাছটি দেখা গেলেও এর প্রকৃত সংখ্যা এখন এক শর কাছাকাছি। এই দুটি প্রজাতির বৃক্ষই এখন ঢাকার বোটানিক্যাল গার্ডেনে আছে এবং বংশবৃদ্ধির প্রচেষ্টা গ্রহণ করা হচ্ছে।

গবেষকদের পরামর্শে এই পাঁচটি মহাবিপন্ন উদ্ভিদই বনে ফেরানোর উদ্যোগ গ্রহণ করেছে সরকার। সুন্দরবন থেকে দুটি অর্কিড প্রজাতির কিছু গাছ সংগ্রহ করে আনা হয়েছে বোটানিক্যাল গার্ডেন ও বাংলাদেশ ন্যাশনাল হারবেরিয়ামে। বংশবৃদ্ধির উদ্যোগও শুরু হয়ে গেছে। কদিন আগে সুন্দরবন থেকে আনা এই দুটি অর্কিড দেখতে গিয়েছিলাম বোটানিক্যাল গার্ডেনে। বেশ ভালোভাবে বেড়ে উঠছে। পরিচর্যাকারী হিরালাল মালি সারাক্ষণ এর যত্ন করছেন। আশা করি, এর বংশ বৃদ্ধি হবে। তারপর এই অর্কিডগুলো আবার ফিরিয়ে নেওয়া হবে সুন্দরবনের বিভিন্ন খালে।

এ দেশে বাঁশপাতা টিকে আছে এক শর কাছাকাছি
ছবি: লেখক

বন খেজুরের গল্পটি আরও সুন্দর। এরই মধ্যে তার বীজ সংগ্রহ করে নিয়ে আসা হয়েছে দিনাজপুরের বন বিভাগের নার্সারিতে। বংশ বৃদ্ধি করে দিনাজপুরের শালবনগুলোতে আবার ছড়িয়ে দেওয়া হবে। একটি গাছ নিয়ে আসা হয়েছে ঢাকার বোটানিক্যাল গার্ডেনে। গাছটিও ভালো আছে। সবকিছু ঠিক থাকলে কয়েক বছরের মধ্যে এ উদ্যোগ সফল হবে।

চালমুগড়াও এ দেশে এখন মহাবিপন্ন
ছবি: ইনামুর রশিদ

এ দেশে প্রায় এক হাজার বৃক্ষ প্রজাতির মধ্যে সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় আছে এই তিনটি বৃক্ষ—বন খেজুর, চালমুগড়া ও বাঁশপাতা। অন্যদিকে ১৯০ প্রজাতির অর্কিডের মধ্যে এই দুটি অর্কিড (ছোট বাল্ব অর্কিড ও বাল্বোরক্স) মহাবিপন্ন। এই পাঁচটি উদ্ভিদের বনে ফিরিয়ে দেওয়ার উদ্যোগ সফল হলে বিরল উদ্ভিদ বনে ফিরিয়ে দেওয়ার প্রথম পদক্ষেপ হবে এটি।