আরাকুলের ভাঙা মঠে পাখির সংসার
অনেক দিন পর পাখি দেখতে ঢাকার কেরানীগঞ্জের আরাকুলে গেলাম। ১৮ এপ্রিল সকালবেলা। এখন পাখিদের বাসা বানানোর মৌসুম শুরু হয়ে গেছে। পাখিরা প্রতিযোগিতায় নেমেছে নিরাপদ নীড়ের খোঁজে। পাখিবন্ধু মো. ফয়সাল আরাকুলের বাসিন্দা। এই এলাকার প্রতিটি অলিগলি তাঁর চেনা। দুই যুগ ধরে এই এলাকার পাখির খবর দেন আমাদের। ধলা বালিহাঁস নামের বুনো আবাসিক হাঁস এই এলাকায় দেখা যেত। একসময় এরা আরাকুলে নিয়মিত বাসা বানাত।
ফয়সালের সঙ্গে আরাকুলের একটি পুরোনো মঠে সকালেই পৌঁছালাম। এই মঠেই সর্বশেষ ২০০৯ সালে বালিহাঁস বাসা বেঁধেছিল। তারপর তার ফিরে আসেনি। এই বালিহাঁসের না ফিরে আসাটা এক করুণ কাহিনি। আরাকুলের এই মঠ শত বছরের পুরোনো। দেশভাগের পর হিন্দুরা ভারতে চলে যায়। মঠটি আস্তে আস্তে পরিত্যক্ত হয়ে যায়। একসময় জাঁকজমক এই স্থান হয়ে পড়ে জনশূন্য। এই সুযোগে মঠের গর্তগুলোতে পাখিরা বাসা বানাতে থাকে। এর মধ্যে বালিহাঁসই বাসায় ছিল সবচেয়ে বড় আকর্ষণ।
বালিহাঁসের বাসার জন্য একটি পুরোনো গর্ত প্রয়োজন। বাচ্চা ফুটলে তার বাসার নিচে পানি দরকার হয়। বাসা থেকে লাফিয়ে এই বাচ্চাগুলো পানিতে পড়ে। তার মা-বাবারা বাচ্চাগুলোকে বড় করে তোলে। একসময় এই আরাকুলে সবই ছিল। হাঁসগুলো মঠের গর্তে বাসা করত আর এর নিচেই ছিল একটি বড় পুকুর। বর্ষা শুরু হলে এই পুকুর মিলে যেত বড় জলাশয়ের সঙ্গে। আর এই জলাশয়ের সংযোগ ছিল বুড়িগঙ্গা নদীর সঙ্গে। এখন চারপাশ ভরাট হয়ে গেছে। কোনো পুকুর বা জলাশয় চোখে পড়ে না। ২০০৯ সালে বালিহাঁসের বাচ্চাগুলো স্থানীয় মানুষেরা ধরেছিল। মা পাখিটিকেও ধরে ফেলেছিল। তার পর থেকে তাদের এই এলাকায় আর ফিরে আসেনি।
বালিহাঁস চলে যাওয়ার পর এই মঠ এখন অন্য সব পাখির দখলে। মঠটিতে চার-পাঁচ প্রজাতির ২৫-৩০টি বাসা দেখা যায়।
১৮ এপ্রিল মঠটিতে গিয়ে হরেক প্রজাতির পাখির সংসার পাতার অভিনব কায়দা দেখলাম। প্রায় কয়েক ডজন শালিক আর টিয়ার মারামারি চলছে মূলত গর্ত দখল নেওয়ার জন্য। যারা গর্ত দখল নিতে পারবে, তারা এই মৌসুমের জন্য একটি নিরাপদ সংসার সাজাতে পারবে। এ রকম এক প্রতিযোগিতা দেখে মনটা ভরে গেল। মাত্র এক ঘণ্টায় দেখলাম, ঝুঁটি শালিকেরা টিয়া পাখিকে তাড়া করছে। শালিকেরা ছোট হলেও তাদের সাহস দেখে অবাক হলাম। গর্তগুলোর বেশির ভাগই এখন শালিকদের দখলে। মে মাসের প্রথম ভাগে এই মঠে গেলে বোঝা দেখা যাবে কোন প্রজাতির পাখি বেশি বাসা বানাল। টিয়া আর শালিক ছাড়া খোঁড়লে প্যাঁচার বাসাও আছে।
পাখিবন্ধু ফয়সাল সেই ছোটবেলা থেকে এই এলাকায় পাখি দেখে বড় হয়েছেন। তাঁর বয়স যত বেড়েছে, পাখির আবাস তত ছোট হয়ে গেছে। বালিহাঁসের বাসাটি হারিয়ে যাওয়ার পর তার কষ্টের সীমা ছিল না। পাখির আবাসগুলো রক্ষায় তার এই আওয়াজ আর কারও কানে পৌঁছায়নি। শেষ পর্যন্ত তিনি ও তাঁর সঙ্গীদের নিয়ে এই এলাকায় নীরবে প্রায় ১০০টি বটগাছ লাগিয়েছেন। এই গাছগুলোর বেশির ভাগই মারা গেছে। যে ১০-২০টি গাছ টিকে আছে, তা নিয়ে তাদের গর্বের শেষ নেই। এই গাছগুলো ফল দিচ্ছে আর পাখিরা তা খাচ্ছে।
ঢাকার কাছে আরাকুল এলাকা পাখির জন্য এক ভিন্ন জগৎ। সাধারণ মানুষের কাছে এই সংবাদ একেবারেই অজানা। আরাকুলের এই মঠ এখন প্রায় অর্ধভঙ্গ অবস্থা। এই মঠে পাখি ছাড়া সাধারণ মানুষের কোনো আগ্রহ নেই। মঠটি আর কত দিন টিকবে, তা জানা নেই। তবে যেভাবে মাটি ভরাট করে শহর গড়ে উঠছে, তাতে বোঝা যাচ্ছে যেকোনো সময় হারিয়ে যাবে যুগ যুগ ধরে বসবাস করা প্রিয় এই পাখিগুলোর সংসার। আমাদের আশা, আরাকুলের মঠটি সঠিকভাবে সংরক্ষণ করা হোক। এতে অনেকগুলো পাখির সুখের সংসার আরও বহুদিন টিকে থাকবে।