পার্বত্য কৃষিতে জীববৈচিত্র্য হুমকিতে

আমাদের ভালোভাবে টিকে থাকার জন্য সবচেয়ে আগে দরকার পরিবেশের সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলা ও ভারসাম্য ঠিক রাখা।

প্রচুর পানি শোষণকারী সেগুনগাছের গোড়ার মাটি ক্ষয় হয়ে গেছে। গত মঙ্গলবার রাঙামাটি সদরের কুতুকছড়ির ধর্মঘর এলাকায়ছবি: সুপ্রিয় চাকমা

এ দেশটা ছোট হলেও দেশের মধ্যে অনেক বৈচিত্র্য আছে। বিশেষ করে কৃষি ও জীববৈচিত্র্যের এক সমৃদ্ধ ভান্ডার হলো আমাদের এই দেশ। পৃথিবীর খুব কম দেশই আছে, যে দেশে বাংলাদেশের মতো ফসলবৈচিত্র্য রয়েছে। প্রায় ৪০০ রকমের ফসল ফলে এ দেশে। আবার এ দেশে রয়েছে সেসব ফসলের হাজার হাজার জাতবৈচিত্র্য। একসময় শুধু ধানেরই ১২ হাজারের বেশি জাত এ দেশে ছিল। ফসলের মতো রয়েছে অন্যান্য উদ্ভিদবৈচিত্র্য। এ দেশে রয়েছে প্রায় ৬ হাজার প্রজাতির গাছপালা, ১ হাজার ৬০০ প্রজাতির মেরুদণ্ডী প্রাণী ও ২ হাজার ৫০০ প্রজাতির অমেরুদণ্ডী প্রাণী। প্রকৃতপক্ষে এখনো বাংলাদেশের জীববৈচিত্র্যের সঠিক হিসাব নির্ণয় করা সম্ভব হয়নি।

আবার ভূমিরূপ বৈচিত্র্যেও এ দেশ অনন্য। হিমালয়ধোয়া মাটি ও পাথরচূর্ণে গঠিত একটি বড় বদ্বীপে রয়েছে প্রচুর জলাভূমি, সাগর, হাওর, গড় ও পাহাড়। একদিকে সাগরধোয়া উপকূল, যেখানে লোনামাটি ও লোনাপানিতে আছে লোনাপানির গাছপালা, কুমির-কচ্ছপ, নদী-খাল, বিল-ঝিলের মিঠাপানিতে আছে প্রায় ৪০০ প্রজাতির মাছ, গাঙ্গেয় শুশুক। সাগরঘেঁষা সুন্দরবন আমাদের প্রাকৃতিক প্রহরী। সেখানে আছে ৫২৮ প্রজাতির উদ্ভিদ ও ৩৩৯ প্রজাতির পাখিসহ প্রায় ১ হাজার ৬০০ প্রজাতির বিভিন্ন জীব, আছে অণুজীবও।

অন্যদিকে এ দেশের চিরসবুজ ও মিশ্র পার্বত্য অরণ্য হলো বিশ্বে ৩৪টি জীববৈচিত্র্যসমৃদ্ধ এলাকার একটি। এসব পাহাড়ি অরণ্যে অর্কিড, বাঁশ, সেগুন, গর্জন, তেলশুর, বৈলামসহ ১ হাজার ৫৬০ প্রজাতির সপুষ্পক উদ্ভিদ রয়েছে। এসব অরণ্য হাতি, লিওপার্ড, হরিণ, ভালুক, প্রজাপতি, গিরগিটি, সাপ, পাখিসহ অনেক প্রাণীর আবাসস্থল। ষাটের দশকের আগে পার্বত্য অঞ্চল ছিল সবুজে সবুজময়, জীববৈচিত্র্যের অফুরন্ত ভান্ডার। কিন্তু ষাটের দশকে কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণ ও মনুষ্য বসতি বৃদ্ধির কারণে পাহাড়ের সবুজতা কমতে শুরু করে। একইভাবে সিলেট ও মৌলভীবাজারে ব্যাপকভাবে চা–বাগান এবং ফসলের চাষ সম্প্রসারিত হওয়ায় পাহাড়ি অনেক বন উজাড় হয়ে যায়। ফলে পাহাড়ের অনেক জীববৈচিত্র্য হুমকিতে পড়ে ও বেশ কিছু প্রজাতি হারিয়ে যায়।

সমতলের কৃষির পার্বত্য যাত্রা

আমাদের প্রাকৃতিক পাহাড়গুলো এখন আর প্রাকৃতিক রূপে থাকছে না। প্রাচীনকালে পার্বত্য অরণ্য ছিল গাছপালার আবাসভূমি, বড় বড় বৃক্ষের ছায়াঘন সবুজে মোড়া পাহাড়ের গা। সেখানে তেমন কোনো মানুষ ছিল না। ছিল বিভিন্ন বন্য প্রাণীর আবাস ও তাদের স্বর্গরাজ্য। দেশে দিন দিন মানুষ বাড়ায় একদিন সেখানে মানুষের পা পড়ে। বনভূমি কেটে সাফ করে গড়ে ওঠে ঘরবাড়ি, খাদ্যের প্রয়োজনে সম্প্রসারিত হয় জুমচাষ। জুমচাষ সাধারণত এক পাহাড়ে এক বছরে একবারই করা হয়। জুমিয়ারা কয়েক বছর সে পাহাড়কে রাইন্যা বা পতিত রেখে আবার সেখানে শুরু করেন জুমচাষ। এভাবে জুমচাষের ফলে মাটি তার প্রাকৃতিক উর্বরতা পুনরুদ্ধারের সুযোগ পায়। আগে জুমচাষ সীমিত আকারে করা হতো। বর্তমানে পার্বত্য অঞ্চলে জুমচাষকে ছাড়িয়ে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে সমতলের নানা রকম ফসলের চাষ।

বর্তমানে পাহাড়ের ঢালে ও ঢালের মধ্যবর্তী খাড়িতে, ছড়ার পাড়ে প্রতিবছর বিভিন্ন মৌসুমে বাণিজ্যিকভাবে ফলানো হচ্ছে সমতলের মতো ঝাড়শিম, বাঁধাকপি, ফুলকপি, ওলকপি, বরবটি, টমেটো, বিলাতি ধনিয়া, তামাক, আখ, মরিচ ইত্যাদি ফসল। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, রাঙামাটিতে ২০২০-২১ সালে ৩ হাজার ৩১৪ একর জমিতে আনারস ও ৩ হাজার ৭৪৮ একরে আম চাষ করা হয়েছে। আম চাষ করা হয়েছে বান্দরবানে ২ হাজার ৮৩৯ একর ও খাগড়াছড়িতে ৪ হাজার ২০৭ একরে। বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমেও সৃজিত হয়েছে অনেক ফলের বাগান। যেসব ফলের চাষ সাধারণত সমতল এলাকায় হয়, সেগুলোই এখন পাহাড়ে হচ্ছে। এটা আমাদের আনন্দিত করে, ঢাকা শহরে পার্বত্য আম্রপালি আমের ব্র্যান্ডিং হয়েছে, দেশে ফলের উৎপাদন বাড়ছে, যা আমাদের পুষ্টি উন্নয়নে সহায়ক হচ্ছে। কিন্তু এর ফলে স্থানীয় পরিবেশ, জীববৈচিত্র্য তথা বাস্তুতন্ত্রের যে ক্ষতি হচ্ছে, তা হয়তো আমরা চোখে দেখছি না, কিন্তু তার প্রভাব সুদূরপ্রসারী। চাষ করতে গিয়ে পাহাড়ের ঢালের যে মাটিকে চাষ দিয়ে আলগা করা হচ্ছে, বৃষ্টিতে সেসব মাটিই ধুয়ে পাহাড়ের ছড়া ও খাল ভরাট করে দিচ্ছে, কখনো কখনো মাটি নরম হয়ে ভূমিধস ঘটাচ্ছে। জলাশয়, নিম্নভূমি, ছড়া ইত্যাদি ভরাট হওয়া মানে অনেক জলজ জীববৈচিত্র্যকে নিশ্চিহ্ন হওয়ার সুযোগ করে দেওয়া।

অনেক পাহাড়ে এখন স্থায়ীভাবে গড়ে উঠেছে আম, কাঁঠাল, লিচু ইত্যাদি ফলের বাগান। চাষ বাড়ছে চা, কফি ও কাজুবাদামের। সম্প্রতি কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর থেকে অবসরে যাওয়া অতিরিক্ত পরিচালক পবন চাকমা বলেন, তাঁর জন্ম ও বেড়ে ওঠা খাগড়াছড়ির পাহাড়ে। তিনি বললেন, ছোটবেলায় যে পাহাড়ি পরিবেশ ছিল, পানির উৎস ছিল, বিভিন্ন প্রাণী ও গাছপালা ছিল, এখন তার অনেকটাই নিঃশেষ হয়ে গেছে। পাহাড়ে জুমিয়ারাও এখন জুমচাষ ছেড়ে অর্থকরী ফসল হিসেবে ব্যাপকভাবে হলুদ, ছড়াকচু বা মুখিকচু ও কাসাভা চাষে ঝুঁকে পড়েছেন। মাটিরাঙ্গা, গুইমারা, লক্ষ্মীছড়ি, মানিকছড়ির পাহাড়গুলোতে এখন এটা খুবই সাধারণ দৃশ্য। এসব ফসল তুলতে মাটি কোপাতে হয়। মাটি কুপিয়ে চাষ করা হচ্ছে আনারস। এতে মাটি আলগা হয়ে পাহাড়গুলো ভঙ্গুর হয়ে যাচ্ছে। আলগা মাটি পাহাড় থেকে গড়িয়ে পড়ছে। সেসব মাটিতে ঝিরিগুলো ভরে যাচ্ছে। ছোটবেলায় মাটিরাঙ্গার ঝিরিতে যে ছোট ছোট দেশি মাছ ছিল, আজ আর সেখানে তার কিছুই নেই।

শুধু মাছ কেন, ২০০৫ সালেও পবন চাকমা মাটিরাঙ্গার ঝরনাটিলায় ভালুকের বাচ্চা দেখেছেন। এরপর আর তা চোখে পড়েনি। ফলবাগান করলেও তা থেকে অনেক সময় কাঙ্ক্ষিত ফলন পাওয়া যাচ্ছে না। যেমন তাপমাত্রা ওঠানামার কারণে কয়েক বছর হলো দেশি লিচুর ফল ধরলেও চায়না ২ ও চায়না ৩ জাতের লিচুর ফল ধরছে না, আমে রোগ ও পোকার আক্রমণ বেড়েছে।

প্রকৃতির রত্নভান্ডারের ক্ষতি

এভাবে চাষাবাদ করতে গিয়ে পাহাড়ের অনেক ঔষধি গাছকেও আমরা যেমন হারিয়ে ফেলেছি, তেমনি সেখানকার নানা প্রজাতির গাছপালার ওপর নির্ভরশীল অনেক জীব প্রজাতিও বিপন্ন হয়ে পড়েছে। সাধারণভাবে ধরা হয়, একটি উদ্ভিদ প্রজাতির কোনো আবাসস্থল থেকে হারিয়ে যাওয়া মানে সেই আবাসস্থলে সেই উদ্ভিদ প্রজাতির ওপর নির্ভর করা অন্তত ৩০ প্রজাতির জীবদের ঝুঁকিতে ফেলে দেওয়া। সমতলের এসব ফসল পাহাড়ে চাষ করতে গিয়ে আমরা কি সেসব জীবসম্পদকে হারিয়ে ফেলছি না? পাহাড়িরা অসুখ-বিসুখ হলে তাঁদের আবাসস্থলে থাকা বিভিন্ন লতাপাতা গাছ দিয়ে চিকিৎসা করে আরোগ্য লাভ করেন। বাংলাদেশ ন্যাশনাল হার্বেরিয়াম গবেষণা করে দেখেছে, পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষেরা অন্তত ৩০২টি রোগ চিকিৎসার জন্য ২ হাজার ২৯৫টি প্রেসক্রিপশন বা চিকিৎসা নিদান হিসেবে ব্যবহার করেন। এসব চিকিৎসায় তাঁরা ব্যবহার করেন প্রায় ৭০০ প্রজাতির বনজ ঔষধি গাছ। সেই ঐশ্বর্যময় বনজ ঔষধির তথ্যভান্ডারের অনেক গাছই আমরা ফসল চাষ করে গিয়ে আগাছা পরিষ্কারের নামে উজাড় করে ফেলেছি। পাশাপাশি সেসব উদ্ভিদের পাতা, গাছের রস, ফলমূল ইত্যাদি খেয়ে যেসব পোকামাকড় ও জীব বেঁচে থাকে, তাদেরও আমরা সেখান থেকে হারিয়ে ফেলছি। এতে মনে হয়, কিছু পেতে গিয়ে আমরা অনেক কিছু হারিয়ে ফেলছি না তো!

খাদ্যের জন্য চাষ আমাদের করতে হবে—এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই। পাশাপাশি এ কথাও মানতে হবে, চাষ করতে গিয়ে কোনো প্রাকৃতিক আবাসস্থল ধ্বংস ও জীববৈচিত্র্যের ক্ষতিসাধন করার অধিকারও আমাদের নেই। দেশের পরিবেশ সংরক্ষণ আইনও তা করতে বলে না। এ দুইয়ের মধ্যে সাম্য স্থাপিত না হলে প্রাকৃতিক ও পরিবেশগত বিপর্যয় অনিবার্য হয়ে ওঠে। ফসলের খেতকে ফসলের জন্য ও পাহাড়কে পাহাড়ের মতো থাকতে দিতে হবে। এ দুই বাস্তুতন্ত্রে বা ইকোসিস্টেমে যে নানা রকম জীববৈচিত্র্যের সহজাত পরিবেশ এবং খাদ্যচক্র গড়ে উঠেছে, সে শৃঙ্খল ছিন্ন করলে তা আমাদের খাদ্যচক্রকেই একদিন ভেঙে দেবে।

পরিবেশদূষণে মানুষের অপকর্ম

পাহাড়ে শুধু ফসল চাষই না, ফসল চাষ করতে গিয়ে আমরা সেখানকার পরিবেশও দূষিত করছি। ছড়া থেকে সেচের পানি তুলতে বা মাটি চষতে যেসব যন্ত্র ব্যবহার করা হচ্ছে, সেসব যন্ত্রে জ্বালানি পুড়ছে। বন উজাড় করে চাষের জমি বানাতে গিয়ে পোড়ানো হচ্ছে সেখানকার আদি ও প্রাকৃতিক গাছপালা। তাতেও ঘটছে বায়ুদূষণ ও কার্বন নিঃসরণ। এ ছাড়া অবৈধ দখল, বন উজাড়, পাহাড় কাটা ইত্যাদি ঘটনা তো আছেই। কৃষিকাজে ব্যবহৃত রাসায়নিক সার ও বালাইনাশক যা আগে পার্বত্য কৃষিতে তথা জুমে কখনো ব্যবহৃত হতো না, এখন বাণিজ্যিক চাষ বৃদ্ধি পাওয়ায় পরিবেশবিরোধী এসব রাসায়নিক দ্রব্যের নির্বিচার ব্যবহার বেড়েছে। এতে পরাগায়নকারী পতঙ্গ থেকে শুরু করে অনেক পোকামাকড় ও জীব মরছে। এর ফলে সেসব বাস্তুতন্ত্রে থাকা মাটি, পানি, বাতাস ইত্যাদি দূষিত হচ্ছে। মাটিতে রাসায়নিক সার ব্যবহারের ফলে মাটিতে থাকা অণুজীবগুলোর এবং সারগলা পানি চুইয়ে নালা ও ছড়ায় এসে মিশে ছোট ছোট মাছের জীবননাশের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

দেয়াল তুলতে পাহাড় কাটা হয়েছে, কাটা মাটি দিয়ে ভরাট করা হয়েছে ধানি জমি। এভাবে পাহাড়ি পরিবেশের ক্ষতি করা হচ্ছে প্রতিনিয়ত। ফলে সেখানকার জীববৈচিত্র্য হুমকিতে পড়েছে। গত মঙ্গলবার রাঙামাটি সদরের শুকরছড়ি এলাকায়
ছবি: প্রথম আলো

আগ্রাসী প্রজাতি

বান্দরবানের সুয়ালোকে গেলে পার্বত্য বনে দেখা যায় মেঞ্জিয়াম ও আকাশমণি গাছের প্রাচুর্য। তেমনি খাগড়াছড়ির রামগড়ে রাবার বনের পাশে বা রাঙামাটির পাহাড়ি ঢালে সেগুনের ছড়াছড়ি। ইউক্যালিপটাসও রয়েছে। ১৮৭৩ সাল থেকে পার্বত্য চট্টগ্রাম, চট্টগ্রাম ও সিলেটের পাহাড়ে সেগুনগাছ লাগানো শুরু হয়। গত শতকের আশির দশকে সে অঞ্চলে সরকারিভাবে সেগুনগাছ লাগানো হয়। স্থানীয় পাহাড়ি মানুষদের অভিজ্ঞতা হলো, সেগুনগাছের তলায় আর কোনো গাছ জন্মাতে পারে না। এর পাতা যেখানে পড়ে স্তূপ হয়, সে মাটিরও ক্ষতি করে। সেগুনের শিকড় মাটির নিচ দিয়ে যত দূর বিস্তৃত হয়, সেসব শিকড় থেকে নতুন নতুন চারা ওঠে। তাই দ্রুত তারা নতুন আবাসস্থলকে গ্রাস করে ফেলে। সেগুনের শিকড় জালের মতো বিস্তৃত হয় না বিধায় তা ভূমিক্ষয়কে রোধ করতে পারে না। দামি কাঠের গাছ, তাই ওগুলো কেউ কেটে সরাতেও পছন্দ করেন না। এরা অন্য প্রজাতির গাছদের ঝেঁটিয়ে বিদায় করে।

পাহাড়ি এলাকায় পানীয় জলের একমাত্র উৎস হলো ছড়া, ঝিরি ও ঝরনাগুলো। পাহাড়িদের অভিজ্ঞতা হলো, প্রাকৃতিক বন উজাড় করে সেখানে ব্যাপকভাবে সেগুন বন করা হলে সেসব গাছ মাটি থেকে প্রচুর পানি শুষে শূন্য করে দিতে পারে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক পবন চাকমা ২০০৮ সালে যখন রাঙামাটি সদর উপজেলা কৃষি অফিসার ছিলেন, তখন চোখের সামনে সেগুন বাগান গড়ে উঠতে দেখেছেন। সেগুন বন গড়ে ওঠার আগে সাপছড়ির ডেপ্পোছড়িতে দেখেছেন সেখানকার খালে পানি ছিল। তিনি বলেন, এখন খাল বা ঝিরি তো দূরের কথা, মাটি খুঁড়েও সেখানে পানি পাওয়া যায় না। বৃষ্টিপাতও হচ্ছে অসমভাবে। পাহাড়ে এখন পানির সংকট চরমে।

আমরা আসবাব তৈরির জন্য সেগুনকে আদর করে লাগালেও সে এখন অনেক জীববৈচিত্র্য ও অরণ্য উদ্ভিদের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। তেমনি আসামগাছ, আসামলতা, কাশ, ছন, লজ্জাবতী, বিলাতি তুলসী, গুয়েগ্যান্দা বা ল্যান্টানা ইত্যাদিও পার্বত্য ভূমিতে আগ্রাসী আচরণ করে চলেছে। এমনকি কাপ্তাই হ্রদ ও কর্ণফুলী নদীতে কচুরিপানাও এখন মাঝেমধ্যে নৌ চলাচলে উদ্বেগ বাড়িয়ে দিচ্ছে। পানির ওপর কচুরিপানার ঘন মাদুরের মতো আচ্ছাদন সূর্যের আলো থেকে বঞ্চিত করে জলাশয়ের পানিকে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় অনেক জলজ জীবের জীবনচক্র। উন্মুক্ত পানি ছাড়া জলফড়িংরা ডিম পাড়তে পারে না। পানি ছাড়া ওদের বাচ্চা বাঁচে না। ডিম না পাড়লে ওদের বংশরক্ষা হবে না। আবার পানিতে বাস করা এসব ফড়িংয়ের বাচ্চাদের খেয়ে বাঁচে মাছেরা। প্রকৃতির সঙ্গে জীবের এই বন্ধন চিরন্তন। অরণ্যের প্রাকৃতিক গাছপালাকে অগ্রাহ্য করে এসব বিদেশি আগ্রাসী গাছের উপস্থিতি মানে সেখানকার বাস্তুতন্ত্রের পরিবর্তন ও দেশি গাছপালার বিলোপ ডেকে আনা। এতে দেশীয় প্রজাতির উদ্ভিদ ও প্রাণীদের স্থানচ্যুত করতে, প্রাকৃতিক পুষ্টিচক্রকে পরিবর্তন করতে ও পাহাড়ি বনের জীববৈচিত্র্যকে কমানোর ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।

কাপ্তাই হ্রদের পাড়ে আমিলাসহ হরেক রকমের শাকসবজি চাষ করা হচ্ছে। সম্প্রতি রাঙামাটি সদরের দীঘলি বাঁক গ্রামে
ছবি: প্রথম আলো

দরকার সঠিক গবেষণা ও পদক্ষেপ

আজ ২২ মে বিশ্ব জীববৈচিত্র্য দিবস। এ বছর এই দিবসে আমাদের অঙ্গীকার প্রকৃতির সঙ্গে সম্প্রীতি ও টেকসই উন্নয়ন। আমাদের ভালোভাবে বেঁচে থাকা ও টিকে থাকার জন্য সবচেয়ে আগে দরকার পরিবেশের সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলা ও ভারসাম্য ঠিক রাখা। এ দেশে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার ওপর বিশেষভাবে জোর দেওয়ার জন্য ১৩টি প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা চিহ্নিত করা হয়েছে। এরূপ এলাকা ঘোষণা করা হয় বিভিন্ন প্রজাতির উদ্ভিদ, প্রাণী তথা জীববৈচিত্র্যকে সংরক্ষণের জন্য। এগুলোর মধ্যে সুন্দরবন থাকলেও পাহাড়ি বনগুলো নেই। অর্থাৎ পার্বত্য অরণ্যকে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন বলে বিবেচনা বা ঘোষণা করা হয়নি।

বাস্তবতার নিরিখে বিষয়টি পুনর্মূল্যায়ন ও গবেষণার দাবি রাখে। এটি ঘোষিত হলে সেখানে অনেক ধরনের পরিবেশ-বিনাশী কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ হবে। এতে প্রাকৃতিক বন ও গাছপালা নির্বিচার নিধন বন্ধ হবে, কোনো প্রকার বন্য প্রাণী শিকার করা হবে না, উদ্ভিদ ও প্রাণীর প্রাকৃতিক আবাসস্থলগুলো রক্ষা পাবে এবং মাটি, পানি, বায়ু ও শব্দদূষণকারী কোনো কর্মকাণ্ড আর সেখানে চলবে না। এতে রক্ষা পাবে দেশের জীববৈচিত্র্য। বিক্ষিপ্তভাবে গবেষণা হলেও আমাদের দেশের সব জীববৈচিত্র্যের এখনো পর্যন্ত কোনো পূর্ণাঙ্গ তালিকা করা হয়নি। এসব নিয়ে গবেষণা বাড়ানো দরকার। কৃষি ও পরিবেশ রক্ষা—এ দুইয়ের মধ্যে সাম্যতার জন্য বিস্তারিত গবেষণা দরকার। পরিবেশবান্ধব কৃষিপ্রযুক্তি উদ্ভাবন ও প্রয়োগই পরিবেশ রক্ষা করে খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে পারে। খাদ্য উৎপাদনের জন্য দেশের ভৌগোলিক অবস্থান ও পরিবেশকে বিবেচনা করে ‘ক্রপ জোনিং’ করা যুক্তিসংগত। এর জন্য এমন পরিকল্পনা ও আইন করা দরকার, যাতে যে কেউ চাইলেই যেকোনো জায়গায় যেকোনো ফসল চাষ করতে পারবে না। সর্বোপরি দরকার জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে স্থানীয় মানুষের কার্যকর সচেতনতা ও সম্পৃক্ততা।

  • মৃত্যুঞ্জয় রায়: কৃষিবিদপ্রকৃতিবিষয়ক লেখক