বায়ুদূষণ বাড়াবে নিম্নমানের ডিজেল 

বিপিসিকে উচ্চমাত্রার সালফারযুক্ত ডিজেল আমদানির সুযোগ দিতে বিএসটিআইয়ের মানমাত্রায় ছাড়। বেশি সালফার বায়ুদূষণ করে।

জ্বালানি তেল
ছবি: সংগৃহীত

দেশে তুলনামূলক নিম্নমানের ডিজেল আমদানির যে পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে, তাতে বায়ুদূষণ আরও বাড়বে। দূষণে বেশি ভুগবেন শিশু, সন্তানসম্ভবা নারী ও প্রবীণ ব্যক্তিরা। নিম্নমানের ডিজেল গাড়ির ইঞ্জিনেরও ক্ষতি করবে। 

বায়ুদূষণ নিয়ে কাজ করা গবেষক ও দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের দুজন শিক্ষক এই আশঙ্কার কথা জানিয়েছেন। তাঁরা বলছেন, পরিবেশ অধিদপ্তর দূষণ কমাতে ভালো মানের ডিজেল ব্যবহার নিশ্চিতের জন্য উদ্যোগ নিয়েছে। এ অবস্থায় নিম্নমানের ডিজেল আমদানির জন্য মানমাত্রায় ছাড় দেওয়া উদ্বেগজনক।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ও বায়ুমানবিষয়ক গবেষক আবদুস সালাম প্রথম আলোকে বলেন, বায়ুদূষণের কারণে মানুষের নানা রোগ বাড়ছে। নিম্নমানের ডিজেল বায়ুদূষণ আরও বাড়াবে। দরকার ছিল আরও কম সালফারযুক্ত ডিজেল আনা। সরকারের এই সিদ্ধান্ত আসলে পেছন দিকে হাঁটা। 

আরও পড়ুন

ডিজেলের মানমাত্রায় ছাড় দেওয়া হয়েছে গত বৃহস্পতিবার শিল্প মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে। সূত্র জানায়, এর আগে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) বেশি সালফারযুক্ত ডিজেল আমদানির সুযোগ চায়। এর কারণ হলো, তাদের আশঙ্কা সেচ মৌসুমে ডিজেল পাওয়া নিয়ে সমস্যা হতে পারে। এ কারণে বেশি সালফারযুক্ত ডিজেল আমদানির জন্য আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত মানমাত্রায় ছাড় চেয়েছে তারা। এতে মার্কিন ডলার ও অর্থ সাশ্রয় হবে। শিল্প মন্ত্রণালয়ের বৈঠকে মানমাত্রা শিথিল করা হয়েছে। তবে শর্ত দেওয়া হয়েছে যে বিপিসি মোট চাহিদার ২০ শতাংশ উচ্চ সালফারযুক্ত ডিজেল আমদানি করতে পারবে। 

বায়ুদূষণ শ্বাসতন্ত্রের রোগ, বিষণ্নতাসহ বিভিন্ন স্বাস্থ্য সমস্যার কারণ। 

■ বেশি ভোগেন শিশু, সন্তানসম্ভবা নারী ও প্রবীণেরা। 

■ বিশ্বব্যাংকের হিসাবে, ২০১৯ সালে ৭৮ থেকে ৮৮ হাজার মানুষের মৃত্যুর জন্য বায়ুদূষণ দায়ী ছিল।

■ ঢাকার বায়ু গত রাতে বিশ্বে সবচেয়ে দূষিত ছিল। 

শিল্প মন্ত্রণালয়ের বৈঠকে উপস্থিত এক ব্যক্তি জানান, বৈঠকে পরিবেশ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে জানানো হয়, ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, চীনসহ বিভিন্ন দেশ যে ডিজেল ব্যবহার করে, তাতে সালফারের মাত্রা থাকে ১০ থেকে ১৫ পিপিএম। ভারত ২০২০ সালের ১ এপ্রিল থেকে এই মানমাত্রা কার্যকর করেছে। বাংলাদেশেও স্বল্পমাত্রার সালফারযুক্ত ডিজেল ব্যবহারের মহাপরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। 

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, বিপিসি এত দিন আমদানির ক্ষেত্রে ৫০ পিপিএম (পার্টস পার মিলিয়ন) পর্যন্ত সালফারযুক্ত ডিজেল আমদানি করতে পারত। আর জ্বালানি তেল পরিশোধনাগার ইস্টার্ন রিফাইনারিতে ৩৫০ পিপিএম পর্যন্ত সালফারযুক্ত ডিজেল উৎপাদিত হয়। বিপিসি ৫০ পিপিএমের ডিজেল যেমন বাজারে ছাড়ত, তেমনি ৩৫০ পিপিএমের ডিজেলও বিক্রি করত। মানমাত্রায় ছাড় পাওয়ার ফলে ৫০০ থেকে আড়াই হাজার পিপিএম সালফারযুক্ত ডিজেলও আমদানি করা যাবে। তবে কম পিপিএমের ডিজেলের সঙ্গে মিশিয়ে বাজারে ছাড়া যাবে ৩৫০ পিপিএম পর্যন্ত সালফারযুক্ত ডিজেল। 

দেশে বিভিন্ন পণ্যের মান নির্ধারণ করে বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই)। বাধ্যতামূলকভাবে মানসনদ নিতে হবে এমন পণ্যের সংখ্যা ২২৯। এর মধ্যে জ্বালানি তেলও রয়েছে। সংস্থাটির সূত্র জানায়, বিপিসি গত বছর ডিজেলের ক্ষেত্রে মানসনদ (সার্টিফিকেশন মার্কস বা সিএম) নেয়। পেট্রল, অকটেন ও কেরোসিনের ক্ষেত্রে তারা এখনো মানসনদ নেয়নি। বাংলাদেশে ডিজেল আমদানির ক্ষেত্রে সালফারের মানমাত্রা ৫০ পিপিএম নির্ধারণ করা হয়েছিল রাষ্ট্রীয় একটি বাহিনী ও অন্য অংশীজনদের তাগিদে। তারা এ বিষয়ে উদ্যোগী হয়েছিল গাড়ির ইঞ্জিন রক্ষায়। কারণ, জিপ নামে পরিচিত স্পোর্ট ইউটিলিটি ভেহিক্যাল (এসইউভি) ৫০ পিপিএমের বেশি সালফারযুক্ত ডিজেল দিয়ে চালালে ইঞ্জিনের ব্যাপক ক্ষতি হয়। 

দেশে বছরে ৪৫ থেকে ৪৬ লাখ টন ডিজেল বিক্রি করে বিপিসি, যা মোট জ্বালানি তেলের চাহিদার ৭০ শতাংশের বেশি। বিএসটিআই বিপিসিকে ডিজেল পরীক্ষার মাধ্যমে তিন বছর মেয়াদি সনদ দিয়েছে। নিয়ম হলো, বাজার থেকে সংগ্রহ করে এই ডিজেলের মান পরীক্ষা করবে বিএসটিআই। ডিজেলের মান পরীক্ষার জন্য বিএসটিআইয়ের পরীক্ষাগার আছে শুধু ঢাকায়। 

বিপিসি বিএসটিআইয়ের মান সনদ নিয়েছে চট্টগ্রাম কার্যালয় থেকে। মান পরীক্ষা কতটুকু হয় জানতে চাইলে বিএসটিআইয়ের চট্টগ্রাম কার্যালয়ের পরিচালক মো. নুরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা মান পরীক্ষা করেন, তবে যতটা দরকার, ততটা হয় না। যেটুকু পরীক্ষা হয়, তাতে তেলের মান সঠিক পাওয়া যায় কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিপিসি যেটা আমদানি করে, সেটার মান ঠিক পাওয়া গেছে। তবে দেশীয় কিছু উৎস আছে, যেখান থেকে তেল সংগ্রহ করা হয়। সেখানে ঘাটতি থাকে। 

সালফার কীভাবে দূষণ করে

রসায়নবিদ ও চিকিৎসকেরা বলছেন, উচ্চমাত্রার সালফারযুক্ত ডিজেল দিয়ে যানবাহন চালালে দূষণ বেশি হয়। যানবাহন থেকে যে ধোঁয়া নির্গত হয়, তাতে ক্ষতিকর রাসায়নিক ও ক্ষুদ্র বস্তুকণা থাকে। এগুলো শ্বাসতন্ত্রের বিভিন্ন রোগের কারণ। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক আবদুস সালাম প্রথম আলোকে বলেন, ঢাকায় যেসব যানবাহন চলে, সেগুলো বিপুল কালো ধোঁয়া নির্গত করে। এতে থাকে কালো কার্বন ও সালফাইড। এগুলো মানুষের শ্বাসকষ্ট, হৃদ্‌রোগ, ডায়বেটিস ইত্যাদির কারণ। তিনি বলেন, মানুষ এখন বেশি ক্যানসারে আক্রান্ত হচ্ছে। এর বড় একটি কারণ বায়ুদূষণ। 

বায়ুদূষণে ক্ষতি জিডিপির ৪.৪%

বায়ুদূষণে ক্ষতি কত, তা নিয়ে বিশ্বব্যাংক গত ৪ ডিসেম্বর একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এতে বলা হয়, ২০১৯ সালে ৭৮ থেকে ৮৮ হাজার মানুষের মৃত্যুর জন্য বায়ুদূষণ দায়ী ছিল। যেসব এলাকায় বায়ুদূষণ বেশি, সেসব এলাকার মানুষ তুলনামূলক বেশি মাত্রায় বিষণ্নতায় ভোগে। বায়ুদূষণের কারণে ক্ষতি দেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৪ দশমিক ৪ শতাংশ। 

ঢাকা বায়ুদূষণের দিক দিয়ে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় দূষিত শহরের একটি। বায়ুর মান পর্যবেক্ষণকারী সংস্থা এয়ার ভিজ্যুয়ালের বায়ুমান সূচকে সবচেয়ে বায়ুদূষণ হওয়া শহরের তালিকায় গতকাল শুক্রবার রাত সাতে নয়টায় ঢাকা ছিল এক নম্বরে। এয়ার ভিজ্যুয়ালের বায়ুমান সূচকে বলা হয়, গত রাতে ঢাকার বায়ু ছিল দুর্যোগপূর্ণ অবস্থায়। 

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ঢাকার লক্কড়ঝক্কড়, জীর্ণ ও পুরোনো বাস, সড়কের ধুলাবালু, ইটভাটা ইত্যাদি দূষণের উৎসের বিরুদ্ধে সরকারি সংস্থার অভিযান চলে নামকাওয়াস্তে। সবার চোখের সামনে দিয়ে পুরোনো বাসগুলো কালো ধোঁয়া ছড়িয়ে চলাচল করলেও ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। সেই বাসগুলো এখন উচ্চমাত্রার সালফারযুক্ত ডিজেল দিয়ে সড়কে চলবে। 

রাজধানীর তালতলার বাসিন্দা উম্মে সালমার পরিবারের তিন সদস্যের রক্তেই উচ্চমাত্রার অ্যালার্জি। তিন বছরের মেয়েকে নিয়ে তাঁকে প্রতি মাসেই চিকিৎসকের কাছে যেতে হয়। তিনি বলেন, যাঁরা দূষণ নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে, তাঁদের কি শিশুদের প্রতি একটু মায়া হয় না?