রাজসিক পাদাউক বীথি
এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে অনেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পাদাউকের ছবি পোস্ট করে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন। পাদাউক অবশ্য এমন উচ্ছ্বাস প্রকাশ করার মতোই একটি ফুল। ফুলটি নিয়ে পুষ্পপ্রেমীদের এমন আগ্রহের কারণ হিসেবে অন্তত দুটি বিষয় চিহ্নিত করা যায়। প্রথমত, গাছটি অনেকটাই দুষ্প্রাপ্য। দ্বিতীয়ত, এমন বিশাল বৃক্ষের মাত্র এক দিনের স্বল্পকালীন প্রস্ফুটন প্রাচুর্য; যা অনেকটাই বিরল।
আপনি কোনো একটি গাছে নিয়মিত চোখ রাখলে দেখা পেতে পারেন দুর্লভ এই ফুলের। দেখবেন অতি প্রত্যুষে সোনালি-হলুদ ফুলে ভরে আছে গাছ। সারা দিন পুষ্প-উৎসব শেষে সন্ধ্যায় কোমল পাপড়িগুলো তাদের শেষ পরিণতির জন্য অপেক্ষা করে। ধীরে ধীরে অসংখ্য হলুদে সজ্জিত হতে থাকে গাছতলা। বিষণ্ন পাপড়িগুলো জড়ো হয় গাছতলায়। পরের দিন ফুলের আর কোনো চিহ্নই থাকে না গাছে। একসময় ধারণা করা হতো, মৌসুমে মাত্র এক দিনের জন্য ফুলটি ফোটে। ইদানীং নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে, কোনো কোনো গাছে একাধিকবারও ফুল ফোটে।
তবু নির্দ্বিধায় বলা যায়, প্রস্ফুটনের স্বল্প স্থায়িত্বের এমন বৈশিষ্ট্য বিরল। শ্যামলী নিসর্গ গ্রন্থে অধ্যাপক দ্বিজেন শর্মা লিখেছেন, ‘এক দিনের ব্যবধানে নিঃশেষে মুছে যাবে সব রং, শুধু নিচে ছড়িয়ে থাকবে অজস্র ঝরা ফুলের হলুদ।’ ঢাকায় প্রধান বিচারপতির বাসভবন থেকে রমনা পার্কের সীমানা পর্যন্ত হেয়ার রোডের ছায়ামাখা সুদৃশ্য পথটির দুই পাশে বেশ বড়সড় কাণ্ডের গাছগুলোই পাদাউক।
ঢাকায় পাদাউকের সবচেয়ে বড় বীথি এটি। ধারণা করা হয়, রমনা–নিসর্গের গোড়াপত্তনের সময় উষ্ণমণ্ডলীয় অনেক বৃক্ষের পাশাপাশি রবার্ট লুইস প্রাউডলক মিয়ানমার থেকে এই গাছগুলোও নিয়ে আসেন এখানে। তিনি ছিলেন লন্ডনের কিউ গার্ডেনের কর্মী।
প্রায় ১২০ বছর আগে ঢাকাকে উদ্যান-নগরী হিসেবে গড়ে তোলার কাজে তাঁর প্রতি দায়িত্ব অর্পিত হয়। কাজটি যে তিনি নিষ্ঠার সঙ্গে করেছিলেন, তার প্রমাণ পাদাউকের এই নান্দনিক বীথিসহ রমনা গ্রিনখ্যাত ঢাকার বিশাল এলাকার বহুবর্ণিল বৃক্ষশোভা। মূলত তাঁর হাত ধরেই এ দেশে পাদাউকের অভিষেক। এখানকার বৃক্ষপ্রেমে তিনি এতটাই আচ্ছন্ন ছিলেন যে চলে যাওয়ার পরও অন্তত দুবার তাঁর লাগানো এই গাছগুলো দেখতে এসেছিলেন।
শুধু ফুলের জন্যই নয়, বিশাল কাণ্ডের এ গাছের ঝুলন্ত ডালপালাও মনোমুগ্ধকর। পাদাউক (Pterocarpus indicus) পত্রমোচী উঁচু বৃক্ষ, সাধারণত ৩০ থেকে ৪০ মিটার উঁচু হতে পারে। কাণ্ড অনুচ্চ, শাখায়িত, পাঁশুটে রঙের, প্রায় মসৃণ, ২ মিটার বা তার বেশি চওড়া হতে পারে।
গাছটির শীর্ষ বিশাল, ছত্রাকৃতি কিংবা এলোমেলো, পত্রঘন শাখান্ত দীর্ঘ ও আনত। শাখা-প্রশাখা নুয়ে পড়ার এই নমনীয় বৈশিষ্ট্য দারুণ উপভোগ্য। পাতা ৫ থেকে ৯টি, মসৃণ, গাঢ় সবুজ, একান্তরে পত্রাক্ষে বিন্যস্ত, সাধারণত ১২ থেকে ২২ সেন্টিমিটার লম্বা হতে পারে। শীতের শেষে নিষ্পত্র গাছে পাতার কোনো চিহ্ন থাকে না। বসন্তের উষ্ণতায় আবার পাতার সবুজ ফিরে আসে।
পুষ্পমঞ্জরি অনিয়ত, শাখায়িত, কাক্ষিক, বহুপৌষ্পিক, ঝুলন্ত ও নাতিদীর্ঘ। ফুল সুগন্ধি, শিমগোত্রীয়, হলুদ রঙের, ৬ থেকে ১৩ সেন্টিমিটার লম্বা। ফল গোলাকৃতি, চ্যাপটা ও বায়ুবাহী। কাঠ দারুমূল্যযুক্ত। আদি আবাস মালয় ও মিয়ানমার। বীজ থেকে সহজেই চারা হয়। বর্তমানে এ গাছের চারা অনেকটাই সহজলভ্য। পাদাউকের ফুল থেকে মধু পাওয়া যায়। পাতা শ্যাম্পু তৈরির উপকরণ হিসেবে ব্যবহার্য। কোনো কোনো অঞ্চলে রোগ সারাইয়ে ফুল ও পাতা খাওয়ার প্রচলন রয়েছে। টিউমারের প্রতিষেধক হিসেবেও গাছটির লোকজ ব্যবহার রয়েছে। কাঠ মজবুত ও সুগন্ধি। আন্তর্জাতিক প্রকৃতি সংরক্ষণ সংস্থা আইইউসিএনের তথ্যমতে, বর্তমানে গাছটি বিপন্ন।
লেখক, প্রকৃতি ও পরিবেশবিষয়ক লেখক