অক্টোবরে ঢাকার বাতাস ৭ বছরের মধ্যে বেশি দূষিত, সামনে কী
রাজধানীতে সাধারণত নভেম্বর মাস থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত বায়ুদূষণ বেশি হয়। এবার অক্টোবর মাসেই বায়ুদূষণ ছিল ভয়াবহ। গত সাত বছরের মধ্যে এই অক্টোবরে সবচেয়ে বেশি দূষিত ছিল ঢাকার বাতাস।
বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, এবার শুকনা মৌসুমে রাজধানীর দূষণ পরিস্থিতি মারাত্মক হয়ে উঠতে পারে। অক্টোবরের অতিরিক্ত দূষণ সেই ইঙ্গিত দিচ্ছে। বেশি দূষণে জনস্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব পড়বে। বাড়তে পারে শ্বাসকষ্টসহ নানা রোগ।
পরিবেশ বন ও জলবায়ুমন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন আহমদ বলেছেন, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সরকার ব্যবস্থা নিচ্ছে। যদিও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে সরকারের নেওয়া কোনো ব্যবস্থাই আর কাজে দিচ্ছে না।
রাজধানীর বায়দূষণ পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস)। তারা ঢাকার মার্কিন দূতাবাস থেকে প্রাপ্ত বায়ুদূষণের তথ্য মূল্যায়ন করে। ২০১৬ থেকে ২০২৩ সালের অর্থাৎ ঢাকার গত ৮ বছরের বায়ুমান সূচক বা একিউআইয়ের তথ্য–উপাত্ত বিশ্লেষণ করছে ক্যাপস। ক্যাপস শুধু ২০১৮ সালের অক্টোবর মাসের তথ্য পায়নি।
কিছু নম্বর বা স্কোরের ভিত্তিতে বায়ুর মান নির্ধারিত হয়। যেমন স্কোর ৫১ থেকে ১০০ হলে তা ‘মাঝারি’ বা ‘গ্রহণযোগ্য’ মানের বায়ু হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ১০১ থেকে ১৫০ স্কোরকে ‘সংবেদনশীল গোষ্ঠীর জন্য অস্বাস্থ্যকর’ ধরা হয়। স্কোর ১৫১ থেকে ২০০ হলে তা ‘অস্বাস্থ্যকর’ বায়ু। স্কোর ২০১ থেকে ৩০০ হলে তা ‘খুবই অস্বাস্থ্যকর’ বায়ু ধরা হয়। ৩০১ থেকে এর ওপরের স্কোরকে ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ ধরা হয়।
২০১৮ সাল বাদ দিয়ে ২০১৬ থেকে চলতি বছর—অর্থাৎ মোট সাত বছরের বায়ুদূষণ পরিস্থিতির তুলনামূলক হিসাব করেছে ক্যাপস। তাদের হিসাবে, এ বছর অক্টোবর মাসে বায়ুমান সূচক বেড়ে গিয়ে ১৫৩-এর বেশি হয়েছে। এর আগে সর্বোচ্চ মান ছিল ২০২১ সালে, ১৫২। আর সবচেয়ে কম ছিল ২০১৭ সালে, ১১৭।
ক্যাপসের গবেষণায় বলা হয়েছে, সাত বছরের অক্টোবর মাসে বায়ুদূষণের গড় মান ছিল ১৩১। চলতি অক্টোবর মাসে ১৬ ভাগ দূষণ বেড়েছে। আর গত বছরের তুলনায় প্রায় সাড়ে ১৬ ভাগ বেড়েছে।
ক্যাপসের চেয়ারম্যান আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, নভেম্বর থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত ঢাকার বায়ুদূষণ বেশি হয়। এবার অক্টোবর মাসও আগের চেয়ে বেশি দূষিত তা দেখা গেল। সামনের দিনগুলোতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না নিলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে। তবে দূষণ নিয়ন্ত্রণে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা চোখে পড়ছে না।
দূষণের উৎসগুলোর নিয়ন্ত্রণ নেই
সরকার, বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ঢাকায় বায়ুদূষণের বড় উৎস ধুলা ও ধোঁয়া। অব্যবস্থাপনার মধ্য দিয়ে চলা নির্মাণকাজ, পুরোনো যানবাহনের ধোঁয়া এসবের উৎস। এ ছাড়া আছে উপমহাদেশীয় দূষিত বায়ু, যা বাংলাদেশে ঢোকে। এই যে উপমহাদেশীয় বায়ুর কথা বলা হলো, ঢাকার বায়ুদূষণের কারণ হিসেবে পরিবেশ অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা এর কথা জোরেশোরে উল্লেখ করেন। পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনমন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিনও এর কথা উল্লেখ করলেন। এই দূষিত বায়ু প্রবাহের প্রসঙ্গে চলতি বছরের মার্চ মাসে বিশ্বব্যাংকের গবেষণায় উঠে আসে।
যানবাহন নিয়ন্ত্রণে আমরা বিআরটিকে বলেছি। আবার নির্মাণকাজে যেন দূষণ নিয়ন্ত্রণ করা হয়, সে বিষয়ে আমাদের তৎপরতা আছে। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন যেন বেশি করে পানি রাস্তায় দেয় এ ব্যাপারেও নির্দেশ দিয়েছি।মো. শাহাব উদ্দিন, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনমন্ত্রী
‘নির্মল বায়ুর জন্য চেষ্টা: দক্ষিণ এশিয়ায় বায়ুদূষণ ও জনস্বাস্থ্য’ শীর্ষক ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার চারটি দেশের ওপর দিয়ে একই মেঘমালা উড়ে যায়। ওই মেঘের মধ্যে দূষিত বায়ু গিয়েও আশ্রয় নিচ্ছে, যা এই দেশে দূষিত বায়ু ছড়িয়ে দিচ্ছে। বিশ্বের দূষিত বায়ুর শীর্ষ ১০টি শহরের ৯টি দক্ষিণ এশিয়ায় অবস্থিত। ঢাকা শহর এর মধ্যে অন্যতম। ঢাকার দূষিত বায়ুর ৩০ শতাংশ আসে ভারত থেকে। তবে ঢাকার বাইরের শহরগুলো থেকেও ৪০ শতাংশ দূষিত বায়ু প্রবাহিত হয়ে ঢাকায় প্রবেশ করে।
ঢাকার ৩০ শতাংশ দূষণ যদি মহাদেশীয় বায়ুর জন্য হয়, তবে বাকি ৭০ ভাগ দূষণ হচ্ছে নগরীর অন্য উৎসগুলো থেকে। সেগুলো নিয়ন্ত্রণে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা এখনো সরকারি স্তরে নেওয়া হয়নি বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক আবদুস সালাম। ইন্টারন্যাশনাল গ্লোবাল অ্যাটমোস্পিয়ারিক কেমিস্ট্রির (আইজিএসি) এই কো-চেয়ার দীর্ঘদিন ধরে বায়ুদূষণ নিয়ে কাজ করছেন।
উপমহাদেশীয় বায়ুপ্রবাহের প্রসঙ্গে অধ্যাপক সালাম বলেন, ‘ধরুন আমার ওপর ২০ কেজি ওজন আছে। এর ওপর নতুন করে ৫ কেজি যুক্ত হয়েছে। এমনিতেই আমাদের দূষণের নানা উৎস আছে। এর মধ্যে এটি শুধু যুক্ত হয়েছে। কিন্তু আমরা নিজস্ব উৎস বন্ধে কোনো কাজ করিনি।’
এবার শুকনা মৌসুমে কী হবে
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক দুটি সংগঠন-হেলথ ইফেক্টস ইনস্টিটিউট ও ইনস্টিটিউট ফর হেলথ মেট্রিকস অ্যান্ড ইভ্যালুয়েশন গত বছর তাদের দেওয়া এক প্রতিবেদনে জানায়, বিশ্বে সবচেয়ে দূষিত বায়ুর শহরের তালিকায় রাজধানী ঢাকার অবস্থান পঞ্চম। প্রতিবেদন অনুযায়ী, দূষিত বায়ুর কারণে ২০১৯ সালে রাজধানীতে ২২ হাজারেরও বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে।
বায়ুদূষণের কারণে রাজধানীতে শ্বাসকষ্ট, শ্বাসতন্ত্রের দীর্ঘকালীন অসুখ দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে বলে প্রতিনিয়ত জানাচ্ছেন চিকিৎসকেরা। জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের (এনআইডিসিএইচ) এক হিসাবে দেখা গেছে, গত বছরের অক্টোবরের মাসের তুলনায় এ বছরের অক্টোবরে ঢাকায় শ্বাসকষ্টের রোগীর সংখ্যা বেড়েছে।
এনআইডিসিএইচের হিসাবে দেখা গেছে, গত বছরের অক্টোবর মাসে হাসপাতালে ভর্তি ছিল এক হাজার ৩৯৪ রোগী, এবার তা হয়েছে ১ হাজার ৪৯৭। গেল বছর এ মাসে মৃত্যু হয়েছিল ৭৯ জনের, এবার ১১।
বক্ষব্যাধি বিশেষজ্ঞ আবদুস শাকুর খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘এ বছরের অক্টোবর মাসে রোগী কিছুটা বেড়েছে। কিন্তু এই একটি হিসাব দিয়েই সবটা বোঝানো যায় না। আসলে রাজধানীর বায়ুদূষণ পরিস্থিতির উন্নতির কোনো লক্ষণ দেখছি না। হাসপাতাল ও ব্যক্তিগত চেম্বারে শ্বাসকষ্টের রোগী দিন দিন বাড়তে দেখছি।’
এবারের শুকনা মৌসুমে কী হবে
ক্যাপসের গবেষণা অনুযায়ী, গত সাত বছরের অক্টোবর মাসের ২১৪ দিনের মধ্যে ৮৮ দিন ছিল ‘সতর্কতামূলক’ বা সংবেদনশীল গোষ্ঠীর জন্য অস্বাস্থ্যকর। সাত বছরে অক্টোবর মাসে ঢাকার মানুষ মাত্র তিন দিন ভালো বায়ু পেয়েছে। এবার পরিস্থিতি অন্য যেকোনো বছরের তুলনায় নাজুক। ইতিমধ্যে নভেম্বরের প্রথম ১০ দিনের মধ্যে ছয়দিন ‘খুব অস্বাস্থ্যকর’ আর চার দিন ‘অস্বাস্থ্যকর’ ছিল।
আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, ‘এবার পরিস্থিতি যা, তাতে আগামী দিনগুলোতে দূষণ আরও বাড়বে। কিন্তু দূষণ রোধে কার্যকর তৎপরতা চোখে পড়ছে না।’
ঢাকার বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণ অনেকটাই প্রকৃতি নির্ভর। পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনমন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন এর আগেও বলেছেন, বৃষ্টি ঠিকমতো হলে ঢাকার বায়ুদূষণ কমবে।
নগরীর দূষণ পরিস্থিতিকে এভাবে প্রকৃতির হাতে সঁপে দিয়ে কত দিন আর পার পাওয়া যাবে—এমন প্রশ্নের জবাবে শনিবার মন্ত্রী প্রথম আলোকে বলেন, ‘বৃষ্টি হলে দূষণ কমে এটা তো বাস্তবতা। আমরা দূষণ নিয়ন্ত্রণে আনতে পারিনি এটাও ঠিক। ঢাকার দূষণে ভারত থেকে আসা দূষিত বায়ুপ্রবাহের একটি বিষয় আছে। আবার যানবাহনের কালো ধোয়া, নির্মাণকাজের প্রভাব আছে।’
এবার নগরীর দূষণ পরিস্থিতি নিয়ে সরকারি তৎপরতা কতটুকু আছে—এর জবাবে পরিবেশমন্ত্রী বলেন, ‘যানবাহন নিয়ন্ত্রণে আমরা বিআরটিকে বলেছি। আবার নির্মাণকাজে যেন দূষণ নিয়ন্ত্রণ করা হয়, সে বিষয়ে আমাদের তৎপরতা আছে। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন যেন বেশি করে পানি রাস্তায় দেয়, এ ব্যাপারেও নির্দেশ দিয়েছি।’
পানি ছিটিয়ে দূষণ রোধের চেষ্টা নতুন নয়। কিন্তু এতে লাভ খুব বেশি নয়। চলতি বছরের মার্চ মাসে গবেষণায় ঢাকার ১২টি স্থানের উপাত্ত বিশ্লেষণে দেখা যায়, পানি ছিটানোর আগে ক্ষুদ্র বস্তুকণার (পিএম ২.৫) পরিমাণ প্রতি ঘনমিটার বায়ুতে ১৫৯ মাইক্রোগ্রাম ও পানি ছিটানোর পরে ক্ষুদ্র বস্তুকণার গড় পরিমাণ ১০৬ মাইক্রোগ্রাম ছিল। অর্থাৎ শতকরা ৩৪ ভাগ কমে এবং বায়ুমান সূচকেরও উন্নতি হয়। যেখানে পানি ছিটানোর আগে বায়ুমান সূচক ছিল ‘সতর্কতামূলক’, পানি ছিটানোর পর সূচক হয়েছে ‘মধ্যম’।
প্রায় আড়াই ঘণ্টা পর বায়ুদূষণ আবার পূর্বাবস্থায় ফিরে যায়। অধ্যাপক আবদুস সালাম বলছিলেন, ‘এবার অক্টোবরে গতবারের চেয়ে বায়ুদূষণ বেশি হয়েছে। গত কয়েক বছরে কখনো দূষণ কম ছিল, এমনটা কেউ বলতে পারবে না। তাহলে কোনো উদ্যোগ কাজে আসছে, তা কী আমরা বলতে পারব?’