শনিবারের শীতের সকাল। পাখি পর্যবেক্ষকদের জন্য ঘরে বসে থাকাটা একেবারেই অস্বস্তিকর। ঢাকার আশপাশে বেশ কয়েকটি জলাশয়ে আসে পরিযায়ী পাখিরা। সারা দিন পাখি দেখে ঘরে ফেরা যায় সন্ধ্যার আগে আগেই। সঙ্গে নেওয়া যায় পরিবারসহ বন্ধুদের। পরিবারের ছোট্ট সদস্যদের পাখি ও প্রকৃতি দেখার দারুণ সব কলাকৌশল শেখানো যায়। আর তারা আগ্রহী হয়ে উঠলে দিন শেষে মনটা ভরে যায়।
গত বছরের নভেম্বর মাসের শেষ শনিবার পাখি দেখতে গেলাম পদ্মা অভয়ারণ্যে। ফাঁকা রাস্তায় দ্রুতগতিতে গাড়ি চালিয়ে মুহূর্তেই পৌঁছে গেলাম মাওয়ার ফিশারিজ ঘাটে। একটি স্কুল মাঠে গাড়ি রেখে তাড়াতাড়ি নাশতা সেরে নিলাম। মাত্র পাঁচ মিনিটের হাঁটা পথে পেয়ে গেলাম তিন জাতের পরিযায়ী খঞ্জন। ঘাট থেকে তিন ঘণ্টার জন্য একটা নৌকা ভাড়া করলাম।
নৌকা ছুটে চলল পদ্মা অভয়ারণ্যের দিকে। পেছন দিকে স্বপ্নের পদ্মা সেতু। বেশ ঘটা করে উদ্বোধন হয়েছে ২৫ জুন। উদ্বোধনের পর এর চারপাশ ঘিরে পর্যটনের দিগন্ত উন্মোচিত হবে বলে বেশ জোরেশোরে বলা হচ্ছিল। কিন্তু হঠাৎ তা আবার স্তিমিত হয়ে গেল। শুধু পদ্মা সেতু ঘিরে মানুষকে আকৃষ্ট করা খুব কঠিন। কিন্তু পদ্মা অভয়ারণ্যে এসে আমার কাছে দারুণ আশাজাগানিয়া মনে হলো।
সকাল ১০টায় ঝলমলে রোদ উঠেছে। খুব বেশি ঠান্ডা নেই। মাথার ওপর দিয়ে একঝাঁক হট্টিটি উড়ে গেল। সংখ্যায় প্রায় ২৫টি। পাখিগুলো একেবারে পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে উড়ে গেল। বাইনোকুলার দিয়ে দারুণ এক সেতুকে অনুভব করলাম। সঙ্গে আমার ছোট্ট মেয়ে কিশোয়া। যেন পাখির চোখ দিয়ে সে–ও সেতুটা দেখে নিল।
নৌকা এগোতে থাকল। আগেই জয়নাল মাঝিকে বলা ছিল, দুটি ঘাসবনের চরে নামব। আর একটি বালুচরে। প্রায় ২০ মিনিটের মধ্যেই আমার সঙ্গী শাহাদাত আরেকটি পাখির খবর দিল। এ রকম একটি জায়গায় কালা মানিকজোড় দেখব, ভাবতেই পারিনি।
৩০ মিনিট পর মাঝি একটি ঘাসবনে আমাদের নামিয়ে দিলেন। হাতের কাছে কী অসাধারণ এক জলাবন! শরৎকাল শেষ, তাই কাশগুলো মরে গেছে। তবে খুব ভালোভাবে টিকে আছে নলবন। হরেক রকমের ঘাসবনের পাখির ডাক। বিশেষ করে প্রিনার ঘন ঘন ডাকে মনটা ভরে গেল। আরও দেখলাম কয়েক জাতের ফুটকি আর চুটকি। সবই পরিযায়ী। বনের ভেতর পোকা আর ঘাসের বিচি তাদের খুব পছন্দ। বনের কাদায় খুব ভালো করে মেছো বিড়ালের পায়ের ছাপ দেখলাম।
খানিকক্ষণ হেঁটে যেতেই কাদা শুরু হলো। ঘন বন, তাই ভেতরে ঢোকা মুশকিল। উপায় না দেখে কিনারা দিয়ে হাঁটতে গিয়ে চোখে পড়ল একদল লোক এই ঘাসবন কাটছে। মনের আনন্দে তাদের এই ঘাসবন কাটা দেখে কষ্টে বুকটা ফেটে যাচ্ছিল। এটা যে একটা বন্য প্রাণী অভয়ারণ্যের ঘাসবন, তাদের কাছে একেবারেই অজানা। ঘাস কাটলে যে ঘাসবনের পাখির আবাস ধ্বংস হয়, তারা শুনে একেবারেই অবাক হলো।
পরের ঘণ্টাটি কাটালাম আরেকটি বনে। একেবারেই নীরব। কোনো মানুষ নেই। পুরো চরটা শুকনা। ১০-১৫ ফুট উঁচু ঘাসের ভেতর দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে মনে হলো, গহিন এক অরণ্যের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। কিছুক্ষণ যাওয়ার পরই পেয়ে গেলাম একটি শিয়াল। আমাদের উপস্থিতি প্রাণীটি একদমই পছন্দ করেনি। খুব ভালো করে ছবি তুললাম পাতি শিলাফিদ্দা আর একঝাঁক বাংলা বাবুই পাখির। তবে অবাক হলাম, ঘাসবনের ভেতর ছোট্ট একটি প্রায় শুকনা জলাশয় দেখে। প্রায় ছয় জাতের সৈকত পাখি দেখলাম। এর মধ্যে গুলিন্দা বাটান সত্যিই বিরল এক পাখি।
ফেরার পথটা আরও আনন্দের ছিল। সহকর্মী সাকিবের বাইনোকুলারে ধরা পড়ল দুই শতাধিক উত্তুরে লেঞ্জা হাঁস। সত্যিই অসাধারণ। পৃথিবীর দীর্ঘ পরিযায়ন পথ অতিক্রম করা হাঁস এরা। দেখা যায় পদ্মা অভয়ারণ্যে। সেতুর প্রায় কাছাকাছি পেয়ে গেলাম গাঙ্গেয় শুশুক। মাত্র তিন ঘণ্টার এক ভ্রমণে আর কী চাই!
ঢাকায় যাঁরা থাকেন, তাঁদের খুব হাতের কাছেই এই পদ্মা অভয়ারণ্য। সরকার ঘোষিত এই অভয়ারণ্যে আছে শতাধিক প্রজাতির পাখি আর ২৫ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী। আরও আছে ইলিশসহ প্রায় ৯০ জাতের মাছ। অভয়ারণ্যটি সত্যিকারের অভয়ারণ্য হিসেবে গড়ে তুলতে পারলে পদ্মা সেতুর মতো এটিও বড় সম্পদ হতে পারে। ঢাকার পাশে আমাদের সন্তানদের জন্য প্রকৃতিপাঠের এক বড় উৎস হতে পারে এই অভয়ারণ্য।
সীমান্ত দীপু, বন্য প্রাণী গবেষক