এক কাপড়ে আশ্রয়কেন্দ্রে এসেছেন আনোয়ারা-আতাউররা

অনেকের মতো আশ্রয়কেন্দ্রে এসেছেন আয়েশা খাতুন। তবে ঘূর্ণিঝড়ে ঘরবাড়ির কী অবস্থা হবে, সেই দুশ্চিন্তায় আছেন তিনি। রোববার কক্সবাজার বাহারছড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আশ্রয়কেন্দ্রেছবি: সৌরভ দাশ

কক্সবাজার সদরের বাহারছড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আশ্রয়কেন্দ্রে এসেছেন আনোয়ারা বেগম। ঘূর্ণিঝড় মোখার কারণে ১০ নম্বর মহাবিপৎসংকেত দেওয়ার পরপরই দুই ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে আশ্রয়কেন্দ্রে চলে আসেন এই নারী। তাঁর বাড়ি কক্সবাজার পৌরসভার সমিতিপাড়ায়। আনোয়ারা বেগম বলেন, ‘জিনিসের কোনো লোভ নাই। জানের প্রতি বড় মায়া। বেঁচে থাকলে অনেক জিনিস জোগাড় করতে পারব। তার আগে বাঁচতে হবে। তাই খালি পরনের কাপড়েই এখানে চলে আসি।’

আজ রোববার সকাল ১০টায় কথা হয় আনোয়ারা বেগমের সঙ্গে। তখন মা-ছেলে সকালের নাশতা করছিলেন।

সমুদ্রের ঠিক পাশেই সমিতিপাড়া। তাই ঘরের জিনিসপত্র সব রেখে এক কাপড়েই চলে আসেন বলে জানালেন আনোয়ারা বেগম। তিনি বলেন, ‘দরিয়ার পাড়ে ঘর। এ জন্য ঝড়ের কথা শুনলে ভয় লাগে। কখন ঝড়-বাতাস সে ঘর উড়িয়ে নিয়ে যায়, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। তাই নিরাপদে চলে আসা ভালো।’

ঘরের জিনিসপত্র না আনলেও গৃহপালিত ঘোড়াকে আনতে তিনি ভুল করেননি। তিনি বলেন, অবলা প্রাণীটির প্রতি মায়া রয়েছে। ঘরে রেখে এলে বেশি ঝড়-বাতাস হলে তখন হারিয়ে যেতে পারে। তাই নিয়ে এসেছেন।

আশ্রয়কেন্দ্রের নিচতলায় ঘোড়াটিকে রাখা হয়েছে। কেন্দ্রে আশ্রয় নেওয়া বিভিন্ন পরিবারের শিশু-কিশোরেরা প্রাণীটিকে নিয়ে আনন্দ করছিল।

বাহারছড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গত দুই দিনে ২৭৩ জন আশ্রয় নিয়েছেন। তাঁদের প্রায় সবার বাড়ি পৌরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ডের সমিতিপাড়ায়।

আনোয়ারা বেগমের মতো এক কাপড়ে আশ্রয়কেন্দ্রে এসেছেন মো. আতাউর রহমান। পেশায় জেলে আতাউর বলেন, প্রশাসনের পক্ষ থেকে বারবার বলা হচ্ছে, ঝড়ের কারণে পানি উঠতে পারে। আবার সাগরপাড়ে তাঁর বাড়ি। তাই দুই ছেলে ও এক মেয়ের নিরাপত্তার জন্য আশ্রয়কেন্দ্রে চলে এসেছেন। তেমন কিছু সঙ্গে আনতে পারেননি। কেন্দ্র থেকে ফিরে ঘরের জিনিসপত্র ঠিকমতো পাবেন কি না, তা নিয়ে চিন্তায় আছেন আতাউর।

ঘূর্ণিঝড় নিয়ে অন্য এক আতঙ্কে আছেন আলমাস খাতুন। ৭০ বছর বয়সী এই নারী জানালেন, ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ে তাঁর স্বামী ভেসে গিয়েছিলেন। পরে তাঁর লাশও পাননি। তিন ছেলেমেয়েকে অনেক কষ্টে বড় করেছেন। ৩২ বছর আগে সবচেয়ে আপনজনকে হারানো আলমাস খাতুন বলেন, সিগন্যালের (সংকেত) কথা শুনলে কেউ ঘর থেকে বের হোক না হোক, তিনি সোজা আশ্রয়কেন্দ্রে চলে আসেন। ঝড় যে কত মারাত্মক হতে পারে, তা তো টের পেয়েছিলেন ’৯১-এর ঘূর্ণিঝড়ে।

ঘরবাড়ি ছেড়ে অনেকেই ঠাঁই নিয়েছেন আশ্রয়কেন্দ্রে। রোববার কক্সবাজার বাহারছড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আশ্রয়কেন্দ্রে
ছবি: সৌরভ দাশ

এদিকে আশ্রয়কেন্দ্রে এসেও ঘরের মায়া ছাড়তে পারছেন না ৬৫ বছর বয়সী আয়েশা খাতুন। তিনি বলেন, তাঁকে কালকে (শনিবার) ঘর থেকে নিয়ে আসা হয়েছে। এখন ঘূর্ণিঝড়ে তাঁর ঘর কেমন আছে? সব ঠিক থাকবে তো? সেই চিন্তায় আছেন।

আজ সকালে আশ্রয়কেন্দ্রটিতে গিয়ে দেখা যায়, বিদ্যালয়ের বিভিন্ন কক্ষে আশ্রয় নিয়েছেন নারী-পুরুষসহ নানা বয়সী মানুষ। নারীদের আলাদাভাবে থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। বাইরে ঘূর্ণিঝড়ের আতঙ্ক থাকলে আশ্রয়কেন্দ্রে তেমন কোনো ছাপ নেই, বিশেষ করে কোমলমতি শিশু-কিশোরদের। তারা নানা ধরনের খেলায় মেতেছে। আশ্রয়কেন্দ্রের এক কক্ষ থেকে অন্য কক্ষে ছোটাছুটি করছে।

ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচির দলনেতা মো. আবদুর রহিম বলেন, এবার মানুষের মধ্যে ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ের মতো আতঙ্ক কাজ করছে। তাই লোকজন হাতের কাছে যা ছিল, তাই নিয়ে আশ্রয়কেন্দ্রে চলে এসেছেন। কেউ কেউ শুধু পরনের কাপড়টিই নিয়ে চলে এসেছেন। তিনি জানান, আশ্রয়কেন্দ্রে আসা মানুষদের রাতে খিচুড়ি এবং সকালবেলায় কেক-বিস্কুট দেওয়া হয়েছে।