পাখির সেই অভয়াশ্রমটি
কুরমা পাখি অভয়াশ্রম। সরু একটি ছড়াকে ঘিরে চা-বাগান, ঝোপঝাড়, ছন ও ঘাসবনে ঘেরা মাত্র একর দশকের একটি জায়গা, বেশ কিছু বিরল ও দুর্লভ পাখির আশ্রয়স্থল। ঢাকা থেকে ২০৬ ও শ্রীমঙ্গল শহর থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে কমলগঞ্জ উপজেলায় এর অবস্থান।
ভারত সীমান্তবর্তী বাংলাদেশ সরকারের ন্যাশনাল টি কোম্পানি লিমিটেডের ৯টি টি এস্টেটের মধ্যে কুরমা অন্যতম। কুরমা টি এস্টেটের ছনবাড়ী এলাকায় এই পাখি অভয়াশ্রম। মাত্র এক বছর আগে এটিকে অভয়াশ্রম হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। অভয়াশ্রমের বিভিন্ন স্থানে পাখি রক্ষার জন্য বন্য প্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন ২০১২–সংবলিত সাইনবোর্ড লাগানো হয়েছে।
কুরমা পাখি অভয়াশ্রম কিন্তু এমনি এমনি হয়ে ওঠেনি। পাখির এই আবাসস্থলের অভয়াশ্রম হয়ে ওঠার পেছনে এক হৃদয়বিদারক কাহিনি রয়েছে। অভয়াশ্রম ঘোষণার আগে এই একচিলতে জায়গাটিতে সাধারণ, বিরল ও দুর্লভ আবাসিক ও পরিযায়ী মিলে ৭৫ থেকে ৮০ প্রজাতির পাখি দেখেছি, যার মধ্যে প্রায় ৬০টি প্রজাতির ছবি তুলতে সক্ষম হয়েছি। কিন্তু এরপরই নেমে আসে বিপর্যয়।
চা-বাগান কর্তৃপক্ষ তাদের বাগান সম্প্রসারণের উদ্দেশ্যে এই ছোট্ট জায়গার ঝোপঝাড়, ছন, নলখাগড়া, ঘাসবন ও গাছপালা কেটে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেন। পড়ে থাকে সরু নালার সঙ্গে গাছপালাহীন একটি ন্যাড়া মাঠ। এরপর এটি নিয়ে প্রথম আলোর শেষের পাতায় ‘একটি পক্ষী নিবাসের মৃত্যু’ শীর্ষক প্রতিবেদন ও সম্পাদকীয় ছাপা হলে চা-বাগান কর্তৃপক্ষের টনক নড়ে। পরবর্তী সময়ে শ্রীমঙ্গলের বন্য প্রাণী উদ্ধারকারী স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘স্ট্যান্ড ফর আওয়ার এন্ডেজার্ড ওয়াইল্ডলাইফ’, মৌলভীবাজার বন বিভাগ ও কিছু পাখিবিশেষজ্ঞের সহযোগিতায় চা-বাগান কর্তৃপক্ষ ‘কুরমা পাখি অভয়াশ্রম’-এর ঘোষণা দেন এবং সাইনবোর্ড লাগানো হয়।
অভয়াশ্রম ঘোষণার এক বছর পর সমমনা কয়েকজনকে নিয়ে ‘কুরমা পাখি অভয়াশ্রম’ পরিদর্শনে যাই ১৪ ডিসেম্বর। একদিন বিশাল চা-বাগানের ভেতর একচিলতে ছন ও ঘাসবনঘেরা জীববৈচিত্র্যসমৃদ্ধ যে পক্ষী নিবাসটি দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম, সেদিন তার বর্তমান অবস্থা দেখে খুব বেশি খুশি হতে পারিনি। যদিও অভয়াশ্রমের একটি অংশ, যেখানে বিভিন্ন প্রজাতির প্রজাপতির আনাগোনা বেশি, সেটি আগের অবস্থায় ফিরে এসেছে কিন্তু বাকি অংশে খুব বেশি পরিবর্তন আসেনি। ন্যাড়া হয়ে যাওয়া মাঠের কোথাও কোথাও ঝোপঝাড় সৃষ্টি হলেও ছন, নলখাগড়া ও ঘাস না জন্মানোয় বেশির ভাগ অংশই খোলা মাঠের মতো রয়ে গেছে।
ফলে যেসব পাখি দিনের খাবার খাওয়া ও বিশ্রামের জন্য গাছে বা নলখাগড়ায় বসত এবং রাতে ঝোপে আশ্রয় নিত, তাদের সংখ্যা মারাত্মকভাবে হ্রাস পেয়েছে। নালা আকারের ছড়াটি আগের মতোই আছে; তবে ছড়ায় যে বিষকাটালি গাছগুলো ছিল, সেগুলো আর গজায়নি। ফলে মুনিয়া, ধানটুনি, বঘেরি এবং এ–জাতীয় বীজভুক পাখিগুলোকে দেখা যায়নি।
একসময় যেখানে গেলে অগুনতি পাখির দেখা মিলত, সেদিন সেখানে মৌবাজ, ছোট সাদা বক, গোবক, সাইবেরীয় শিলাফিদ্দা, ছোট কানাকুক্কা, ভরত, টিকেলের চুটকি, বাদামি ও লম্বালেজি কসাই, খোঁড়লে প্যাঁচা, ইন্দোচীনা নীলকণ্ঠ ইত্যাদি ছাড়া অন্য কোনো আবাসিক বা পরিযায়ী পাখির দেখা পাইনি। কুরমার নিয়মিত আবাসিক পাখি, যেমন সোনালিমাথা ধানটুনি (গোল্ডেনহেডেড চিস্টিকোলা), নাগরবাটই, হলদেচোখ ছাতারে, লালঘাড় পেঙ্গা, লাল মুনিয়া, সাদা-কোমর মুনিয়া ইত্যাদি এবং পরিযায়ী পাখি, যেমন বঘেরি, খয়েরি-কান বঘেরি, হলদে-বুক বঘেরি, খুদে বঘেরি, বনফুলের সোনাপাখি, পাতি তুতি, সাইবেরীয় লালগলা, পাকড়া ঝাড়ফিদ্দা, ঘাড়ব্যথা ইত্যাদির টিকিটিরও দেখা পাইনি। সম্ভবত খাদ্য, আশ্রয় ও নিরাপত্তার অভাবে ওদের আনাগোনা কমে গেছে।
অভয়াশ্রম বর্তমানে যে অবস্থায় আছে, তাতে বছর দুয়েকের আগে মনে হয় না আগের অবস্থায় ফিরে আসবে। তবে চা-বাগান কর্তৃপক্ষ যদি ঘাস, নলখাগড়া ও বিষকাটালিগাছ লাগানোর উদ্যোগ গ্রহণ করে এবং অভয়াশ্রমটির দিকে একটু নজর দেয়, তাহলে আশা করা যায়, আগামী শীতে বিভিন্ন প্রজাতির আবাসিক ও পরিযায়ী পাখির কলকাকলিতে অভয়াশ্রমটি মুখর হয়ে উঠবে। কুরমার প্রকৃতি ফিরে পাবে প্রাণ।