আমাদের সরালি হাঁসেরা

মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলের বাইক্কা বিলের পাশের পুকুরে চারটি বড় সরালিছবি: লেখক

সপ্তাহ তিনেক আগের ঘটনা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বশেমুরকৃবি) অ্যাকুয়াকালচার বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক মো. আমজাদ হোসেন তাঁর গবেষণা পুকুরে অবস্থান করা একঝাঁক পাখির বর্ণনা দিয়ে ওদের পরিচয় জানতে চাইলেন।

সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ে গেল ছয় মাস আগের কথা। ৪০ মিনিটের একটানা হাঁটা শেষ করে মাত্র নতুন ১০ তলা ছাত্র হোস্টেলের সামনে এসে দাঁড়িয়েছি। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। এমন সময় পরিচিত এক পাখির ঝাঁকের ডাক কানে ভেসে এল। ডাকটি ক্রমেই কানের কাছাকাছি আসতেই আধো আলোতে স্পষ্ট দেখলাম একঝাঁক হাঁস পাশের গবেষণা মাঠে নামল। কষ্ট করে গুনে দেখলাম ঝাঁকে মোট ৩৪টি পাখি। কদিন পর একই সময় আবারও ওদের দেখলাম। এবার ঝাঁকে ২৩টি পাখি গুনতে পারলাম। যদিও পাখিগুলো এ দেশে বহুল দৃশ্যমান, কিন্তু আমাদের ক্যাম্পাসে এই প্রথম ওদের দেখলাম।

যাহোক, অধ্যাপক আমজাদ ভাইকে ওদের সম্ভাব্য পরিচয় দিলাম। পরের সপ্তাহের এক বিকেলে ক্যামেরা হাতে মাৎস্য অনুষদের গবেষণা পুকুরের সামনে হাজির হলাম এবং আবিষ্কার করলাম ছয় মাস আগে দেখা সেই হাঁসগুলোর ঝাঁকটিকে। তবে ঝাঁকে মাত্র ১৩টি হাঁসের দেখা মিলল। অত্যন্ত ভালো লাগল এই ভেবে যে এবার হয়তো পাখিগুলো এখানে বংশ বৃদ্ধি করবে।

বশেমুরকৃবি ক্যাম্পাসে দেখা হাঁসগুলো এ দেশের আবাসিক পাখি সরালি। ছোট সরালি, সরাল, শরাল, গেছো/শিঙ্গেল হাঁস নামেও পরিচিত। অ্যানাটিডি গোত্রের হাঁসটির বৈজ্ঞানিক Dendrocygna javanica। বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত, পাকিস্তান, নেপাল হয়ে চীন ও ইন্দোনেশিয়া পর্যন্ত এদের আবাস এলাকা বিস্তৃত। দেহের দৈর্ঘ্য ৩৮ থেকে ৪২ সেন্টিমিটার ও ওজন ৪৫০ থেকে ৫০০ গ্রাম।

এ দেশে এই হাঁসের একটি জাতভাই রয়েছে। নাম তার রাজ/বড় সরালি। ফরালি হাঁস বা রামকোয়া নামেও পরিচিত। শীতে পরিযায়ী হিসেবেও বেশসংখ্যক বড় সরালি আবাসিক পাখিগুলোর সঙ্গে যোগ দেয়। ইংরেজি নাম ফুলভাস/লার্জ হুইসলিং ডাক। বৈজ্ঞানিক নাম Dendrocygna bicolor। বাংলাদেশ ছাড়াও এশিয়া, আফ্রিকা, ইউরোপ ও আমেরিকা মহাদেশের বহু দেশে দেখা যায়। আকার ও ওজনে এটি সরালির প্রায় দ্বিগুণ। দৈর্ঘ্যে ৪৫ থেকে ৫৩ সেন্টিমিটার। ওজনে হাঁসা ও হাঁসি যথাক্রমে ৭৪৮ থেকে ১ হাজার ৫০ ও ৭১৮ থেকে ১ হাজার গ্রাম। বড় সরালির সঙ্গে আমার প্রথম দেখা হয় বাগেরহাট জেলার ফকিরহাটে ১৯৯৬ সালে। এরপর ২০১৪ সালের জানুয়ারির এক পড়ন্ত বিকেলে শ্রীমঙ্গলের বাইক্কা বিলের পাশের একটি পুকুরে।

একনজরে হাঁস দুটি দেখতে অনেকটা একই রকম। পালকে কালচে থেকে লালচে বাদামির প্রাধান্য। তবে বড় সরালিতে লালচে ভাবটা একটু যেন বেশি। আকার ও ওজন ছাড়াও বড় সরালির লম্বা গলার মাঝখানটা সাদাটে ও তাতে থাকে কালচে দাগছোপ। অন্যদিকে ছোট সরালির বাদামি গলাটি বড়টির থেকে খাটো। দুই প্রজাতির ক্ষেত্রেই হাঁসা ও হাঁসি দেখতে একই রকম।

শীতে বড় ও ছোট সরালি নলবন, অগভীর হ্রদ, বড় নদী, মোহনা, হাওর, বিল, জলাভূমি ও ধানখেতে বড় দলে বিচরণ করে। প্রায়ই ছোট সরালির ঝাঁকের মধ্যে অল্প কটি বড় সরালিকে ঘুরে বেড়াতে দেখা যায়। ছোট সরালির চেয়ে বড় সরালির ঝাঁকে পাখির সংখ্যা কম থাকে। ওরা ভোর ও রাতে বেশি সক্রিয়। পানিতে ঘন ঘন ডুব দিয়ে অথবা সাঁতরে জলজ কচি ঘাস, শস্যবীজ, মাছ, ব্যাঙ, গুগলি ইত্যাদি আহার করে। দিনে পানি, মাটিতে বা গাছের ওপর বিশ্রাম নেয় ও ঘুমায়। বড় সরালি উচ্চ স্বরে ‘নি-উই-উ—নি-উই-উ—-’ ও ছোট সরালি শিস দিয়ে ‘হুই-হুয়ি—হুই-হুয়ি—-’ স্বরে ডাকে।

দুই প্রজাতিই জুন থেকে অক্টোবরে প্রজনন করে। এ সময় এরা ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। হাঁসা-হাঁসি সারা জীবনের জন্য জোড়া বাঁধে। গাছের প্রাকৃতিক কোটরে, বড় শাখার ভাঁজে, নলবন, উলুবন, খেতের আল বা জলাসংলগ্ন ঘাসবনে বাসা বানায়। ডিম পাড়ে ৬ থেকে ১২টি, রং সাদা। হাঁসা-হাঁসি উভয়ে মিলেই তা দেয়। হাঁসি তায়ে থাকলে হাঁসা বাসা পাহারা দেয়। ডিম ফোটে ২৪ থেকে ২৬ দিনে। হাঁসা-হাঁসি উভয়েই ছানাদের লালন–পালন করে। সদ্য ফোটা ছানাগুলো পালক শুকানোমাত্রই বাসা থেকে লাফিয়ে পানিতে পড়ে ও মা-বাবার সঙ্গে সাঁতরে চলে যায়। ছানারা দেড় থেকে দুই মাসে উড়তে শেখে। আয়ুষ্কাল পাঁচ থেকে ছয় বছর।

আ ন ম আমিনুর রহমান, পাখি ও বন্য প্রাণী প্রজনন ও চিকিৎসাবিশেষজ্ঞ