পথভোলা সামুদ্রিক পাখিগুলো

পদ্মা নদীতে ভাসমান খাটোলেজি পানিকাটা পাখিছবি: উজ্জ্বল দাস

সময়মতো ঘুম থেকে উঠতে না পারায় হাজার হাজার কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে পথভ্রষ্ট হয়ে দেশের ভেতরে ঢোকা মহাসমুদ্রের পাখিগুলোকে দেখতে পেলাম না। যাঁদের সঙ্গে মাওয়া-জাজিরা পয়েন্টে পদ্মা নদীতে যাওয়ার কথা, তাঁদের সবাই সহজেই তিন-চার প্রজাতির বিরল পাখির ছবি তুলতে পারলেন। গত ৩১ মের ঘটনা এটি।

পরের দিন ১ জুন ডা. শাওন দেব, ডা. নিসর্গ অমি, উজ্জ্বল দাস ও আমি—চারজনের টিমে সকাল আটটায় পদ্মা সেতুর পাশে মাওয়ার পুরোনো ফেরিঘাটে পৌঁছালাম। আজহার মাঝির ইঞ্জিন বোট ঘাটেই ছিল। দ্রুত বোট সেতুর পিলারগুলোর কাছে চলে গেল। তন্নতন্ন করে পাখিগুলোকে খুঁজতে লাগলাম। মুন্সিগঞ্জের মাওয়া থেকে খুঁজতে খুঁজতে শরীয়তপুরের জাজিরা পয়েন্টে চলে এলাম। কিন্তু একটি পাখিরও দেখা পেলাম না। সঙ্গে থাকা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিজ্ঞানের ছাত্র উজ্জ্বল দাস আগের দিন একই জায়গা থেকে পাখিগুলোর ছবি তুলেছেন।

পদ্মা সেতুর ৩০ নম্বর পিলারের কাছে এসে বোট ডানে ঘোরালাম। কিছু দূর এগোতেই মাছ ধরার জালের ওপর একঝাঁক ধূপ বা ছোট বককে মাছ শিকার করতে দেখলাম। চমৎকার এক দৃশ্য! ইঞ্জিন বোট ওদের পেছনে ফেলে চলে যেতেই আকাশে এক গাঙচিলের আবির্ভাব ঘটল। ক্যামেরার ভিউ ফাইন্ডারে চোখ রাখলাম। জীবনে প্রথম দেখলেও ওকে চিনতে বিন্দুমাত্র কষ্ট হলো না। মনের আনন্দে শাটারে তর্জনীর চাপ বাড়াতে থাকলাম। একসময় আমাদের ঠিক সামনে ভাসতে থাকা ছোট্ট একটুকরা স্টাইরোফোমের ওপর এসে বসল সে। মুহূর্তেই আরেকটি পাখি ওর সঙ্গে যোগ দিল। মনের মতো করে ওদের ছবি তুলে বাকি তিন প্রজাতির খোঁজে সামনে এগোলাম। কিন্তু প্রায় তিন ঘণ্টা তন্নতন্ন করে খুঁজেও দেখা পেলাম না। গতকালের ট্রিপ মিস করার জন্য বেশ আফসোস হলো। তবে এই ভেবে ভালো লাগল যে ওরা হয়তো নিজ ঠিকানার উদ্দেশে রওনা হয়ে গেছে।

এতক্ষণ পথভ্রষ্ট যে পাখিগুলোর কথা বললাম, ওরা গত ২৬ মে বাংলাদেশে আঘাত হানা সুপার সাইক্লোন রিমালের কবল থেকে বাঁচার জন্য মহাসমুদ্র থেকে দেশের ভেতরের নদীতে ঢুকে পড়েছিল। প্রথমে রাজশাহীর পদ্মা নদীতে উইলসনের ঝোড়োপেট্রেল (উইলসনস স্টর্ম পেট্রেল) ও কালচে গাঙচিল (সুটি টার্ন) নামে দুটি পাখির দেখা মেলে। পরে মাওয়া-জাজিরা পয়েন্টে পদ্মা নদীতে এ দুটি ছাড়াও লাগামযুক্ত গাঙচিল (ব্রিডল্ট টার্ন), খাটোলেজি পানিকাটা (শর্ট-টেইল্ড ‍শিয়ারওয়াটার) ও জুয়ানিনের পেট্রেল (জুয়ানিনস পেট্রেল) নামে আরও তিনটি পাখির দেখা মেলে। আজ জাজিরা পয়েন্টের কাছে আমাদের দেখা পাখিজোড়া ছিল লাগামযুক্ত গাঙচিল। এ ছাড়া ভোলায় দেখা গেছে উইলসনের ঝোড়োপেট্রেল ও কালচে গাঙচিল।

চার বছর আগে ২০২০ সালে ঘটে যাওয়া সুপার সাইক্লোন আম্পানের কারণে প্রথমবারের মতো দেশের ভেতরে মহাসমুদ্রের পাঁচ প্রজাতির পাখি ঢুকেছিল। এর মধ্যে ঢাকার লালমাটিয়ায় কীলক পানিকাটা (ওয়েজ-টেইলড শিয়ারওয়াটার) এবং রাজশাহীর পদ্মা নদীতে কালচে গাঙচিল, লাগামযুক্ত গাঙচিল, উইলসনের ঝোড়োপেট্রেল ও লম্বালেজি জলদস্যু পাখি (লং-টেইলড স্কুয়া) দেখা গিয়েছিল।

লাগামযুক্ত গাঙচিল। ছবিটি লেখক ১ জুন জাজিরা পয়েন্টে পদ্মা নদী থেকে তুলেছেন।

এই পাখিগুলো জীবনের বেশির ভাগ সময় মহাসমুদ্রে কাটায়। শুধু বংশবৃদ্ধির সময় উপকূলে আসে। যদিও ওরা দেশের পক্ষিতালিকায় দুর্ঘটনাবশত যুক্ত হওয়ায় কিছু আলোকচিত্রীর পক্ষিতালিকা সমৃদ্ধ হয়েছে। কিন্তু এটা কখনোই কাম্য নয়। কারণ, ঝড়ের তাণ্ডবে পথভ্রষ্ট হয়ে জীবন বাঁচাতে ২০২০ সালে সে পাখিগুলো পদ্মায় এসেছিল, ওরা কি শেষ পর্যন্ত হাজার হাজার কিলোমিটার দূরের নিজ গন্তব্যে ফিরে যেতে পেরেছিল? এ সম্পর্কে পুরোপুরি না জানা গেলেও অসমর্থিত সূত্রমতে, ওরা ফিরে যেতে পারেনি।

সেদিন (১ জুন) আমরা পদ্মায় পাঁচ প্রজাতির মধ্যে শুধু লাগামযুক্ত গাঙচিলের দেখা পেয়েছি। তাদের একটিকে মাছ শিকার করে খেতেও দেখেছি। খেতে পারলে হয়তো ওরা বেঁচে যাবে। তবে নিজ গন্তব্যে ফিরতে পারবে কি না, কে জানে? বাকি চার প্রজাতির পাখিগুলোকে না দেখে ভেবে নিয়েছি, ওরা হয়তো নিজ গন্তব্যের পথে রয়েছে। কিন্তু আসলেই কি তা–ই? তার কিছুই আমরা জানি না। তবে কামনা করি, ওরা ফিরুক নিজ গন্তব্যে। আর কখনো দুর্ঘটনার শিকার হয়ে যেন দেশের অভ্যন্তরীণ নদীতে না আসে।

  • আ ন ম আমিনুর রহমান, পাখিবন্য প্রাণিচিকিৎসাপ্রজননবিশেষজ্ঞ